আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা যখন আবার তুঙ্গে, ঠিক সেই সময়ই দিলেন তালিবান সরকারের অন্যতম শীর্ষ নেতা এবং আফগান উপ-প্রধানমন্ত্রী (অর্থনৈতিক বিষয়) মোল্লা আবদুল গনি বারাদার একটি তীব্র ও সরাসরি হুঁশিয়ারি (Taliban warning)। কমান্ডো বাহিনীর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বারাদার স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “আমরা কাউকে আমাদের ভূখণ্ড লঙ্ঘন করতে দেব না।”
যদিও তিনি সরাসরি পাকিস্তানের নাম নেননি, কিন্তু বক্তব্যের ভাষা ও সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ পরিষ্কার করে দিচ্ছে এই বার্তা মূলত পাকিস্তান সেনা ও ইস্টাব্লিশমেন্টের উদ্দেশেই। বারাদারের মন্তব্যের আগের কয়েক সপ্তাহে পাকিস্তান একাধিকবার আফগান আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তালিবানের মতে, পাকিস্তানের সেনা ও বিমানবাহিনী সীমান্তবর্তী এলাকায় ড্রোন নজরদারি, বিমান উড়ান এবং গোলাবর্ষণের মতো উস্কানিমূলক কৌশল চালাচ্ছে।
বারাদারের বক্তব্য ছিল কঠোর ও দৃঢ়। তাঁর ভাষায়—
“শত্রুরা আমাদের ভূমি ও সার্বভৌমত্বের দিকে খারাপ নজরে তাকাবেন না। আফগানদের ধৈর্য আর পরীক্ষা করবেন না। আমরা অন্য দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী, কিন্তু আগ্রাসন হলে জবাব দেওয়া হবে।”
এই বার্তাটি কেবল রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, এটি তালিবানের সামরিক প্রস্তুতির একটি প্রকাশ্য ঘোষণা হিসেবেও দেখা হচ্ছে। কারণ তিনি বক্তৃতাটি দেন নবস্নাতক কমান্ডো বাহিনীর সামনে, যাদের তিনি সরাসরি বলেন, “আপনারা দেশের ঢাল, আপনাদের দায়িত্ব সীমান্ত রক্ষা।”
🔥 সাম্প্রতিক ঘটনাই উত্তেজনা বাড়িয়েছে
গত দুই মাসে পাকিস্তান আফগানিস্তানের কুড়ান, খোস্ত, নানগরহার, পাকতিকা ও কান্ধার প্রদেশের উপরে একাধিকবার ড্রোন ও যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে বলে দাবি করেছে আফগান কর্তৃপক্ষ। বিশেষত তালিবান সরকারের অভিযোগ
-
পাকিস্তানের ড্রোন আফগান আকাশে ঢুকে নজরদারি চালিয়েছে
-
পাকিস্তানি সেনা সীমান্ত বরাবর গোলাবর্ষণ করেছে
-
কিছু অঞ্চল লক্ষ্য করে রকেটও ছোঁড়া হয়েছে
এইসব ঘটনাকে তালিবান সরকার “সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন” হিসেবে দেখছে।
অন্যদিকে পাকিস্তান তাদের পক্ষ থেকে বলছে—আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে প্রবেশ করা TTP (তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান) জঙ্গিরা হামলা চালাচ্ছে, তাই সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তবে তালিবান বারবার দাবি করেছে, “পাকিস্তানের সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। এর দায় আমাদের ওপর চাপানো যাবে না।”
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফের মন্তব্যও নাড়িয়েছে পরিস্থিতি
কয়েক মাস আগে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ প্রকাশ্যে বলেছিলেন “আফগানরা পাকিস্তানের শত্রু।”
এই মন্তব্য কেবল কূটনৈতিক সম্পর্কই খারাপ করেনি, বরং পুরো আফগানিস্তানে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। তালিবান নেতৃত্বসহ সাধারণ মানুষ পাকিস্তানকে “ভাই দেশ” নয় বরং “শত্রু দেশ” হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন।
এই প্রেক্ষাপটেই বারাদারের বক্তব্য যেন কূটনৈতিক ভাষার আড়াল সরিয়ে স্পষ্ট অবস্থান জানাল, “সীমান্তের ওপর হামলা হলে প্রতিরোধ হবে।”
🛡️ তালিবানের সামরিক মনোভাব পরিবর্তনের ইঙ্গিত
২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার পর তালিবান সরকারের অবস্থান তুলনামূলকভাবে নরম ছিল। তারা কূটনীতি, বাণিজ্য ও শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষার কথা বলেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের ধারাবাহিক সীমান্ত আগ্রাসন ও রাজনৈতিক মন্তব্যের পর এখন তালিবানের অবস্থান বদলাতে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে—
-
তালিবান তাদের অভ্যন্তরীণ সমর্থন ধরে রাখতে কড়া অবস্থান নিতে বাধ্য
-
পাকিস্তানের সীমান্ত উস্কানি তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করছে
-
নতুন প্রজন্মের কমান্ডো বাহিনীকে শক্তিশালী বার্তা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল
বারাদারের বক্তব্য তাই শুধু পাকিস্তানের উদ্দেশ্য নয়—এটি তালিবানের শক্তির অভ্যন্তরীণ প্রদর্শনও।
🔎 কেন এখনই এই হুঁশিয়ারি?
১. ডুরান্ড লাইন নিয়ে দীর্ঘদিনের বিবাদ:
আফগানিস্তান কখনোই ডুরান্ড লাইনকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। পাকিস্তান যেটিকে ‘সীমান্ত’ বলে চিহ্নিত করে, তালিবান সেটিকে “জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ঔপনিবেশিক বিভাজন” বলে মনে করে।
২. TTP ইস্যুতে দুই দেশের টানাপোড়েন:
পাকিস্তান দাবি করছে আফগান ভূমি থেকে TTP হামলা চালানো হচ্ছে। আর তালিবান বলছে, “আফগান ভূমিতে কোনো জঙ্গি নেই।”
৩. সাম্প্রতিক ড্রোন হামলা ও গোলাবর্ষণ:
নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান একাধিক সীমান্ত এলাকায় মিসাইল ও শেল ছুঁড়েছে বলে অভিযোগ।
৪. পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা:
শেহবাজ শরিফ সরকার ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থ হওয়ায় দোষ চাপাচ্ছে আফগানিস্তানের ওপর—এমন ধারণা অনেক বিশ্লেষকের।
🔥 পরিস্থিতি কোথায় গড়াতে পারে?
বারাদারের এই বক্তব্য সরাসরি আফগানিস্তান-পাকিস্তান সম্পর্ককে নতুন টানাপোড়েনে ঠেলে দিল। সীমান্তে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে।
অনেকে মনে করছেন—
-
সীমান্ত সংঘর্ষ বাড়তে পারে
-
দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনা কঠিন হয়ে পড়বে
-
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ আরও বৃদ্ধি পাবে
-
তালিবান আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে
বারাদারের কড়া হুঁশিয়ারি কেবল পাকিস্তানের জন্য একটি সতর্কবার্তা নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলের জন্য একটি সংকেত— আফগানিস্তান আর আগের মতো নরম অবস্থানে থাকবে না। তাদের সীমান্ত লঙ্ঘন হলে এবার প্রতিক্রিয়া আসবে, এবং তালিবান নেতৃত্ব সেটি খোলা ভাষায় ঘোষণা করেই দিল।
