তালিবানি কঠোর নিয়মে আফগান-ভূমিকম্পে মহিলারা ত্রাণ পাচ্ছে না

আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কুনার ও নঙ্গারহার প্রদেশে ৩১ আগস্ট, ২০২৫-এ সংঘটিত ৬.০ মাত্রার ভূমিকম্পে (Afghanistan Earthquake) কমপক্ষে ২,২০০ জন নিহত এবং ৩,৬০০ জন আহত হয়েছেন। এই…

Taliban Rules Delay Aid for Women in Afghanistan Earthquake Crisis

আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কুনার ও নঙ্গারহার প্রদেশে ৩১ আগস্ট, ২০২৫-এ সংঘটিত ৬.০ মাত্রার ভূমিকম্পে (Afghanistan Earthquake) কমপক্ষে ২,২০০ জন নিহত এবং ৩,৬০০ জন আহত হয়েছেন। এই বিপর্যয় গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করেছে, অসংখ্য মানুষকে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে ফেলেছে। তবে, এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও তালিবানের কঠোর লৈঙ্গিক নিয়ম এবং সাংস্কৃতিক বিধিনিষেধ মহিলাদের জন্য ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তাকে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ভূমিকম্পের (Afghanistan Earthquake) ৩৬ ঘণ্টা পরেও কোনও মহিলা ত্রাণ সহায়তা পাননি, কারণ তালিবানের নিয়ম পুরুষ উদ্ধারকারীদের মহিলাদের স্পর্শ করতে নিষেধ করে, এমনকি জীবন-মরণ পরিস্থিতিতেও। এই নিয়মের কারণে অনেক মহিলা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন বা চিকিৎসা না পেয়ে কষ্ট পাচ্ছেন।

তালিবানের লৈঙ্গিক নিয়ম এবং মহিলাদের দুর্দশা
তালিবানের “অপরিচিত পুরুষের সাথে শারীরিক স্পর্শ নিষিদ্ধ” নিয়ম অনুসারে, পুরুষ উদ্ধারকারীরা জরুরি পরিস্থিতিতেও মহিলাদের স্পর্শ করতে পারেন না। এই নিয়মের ফলে অনেক মহিলা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে থাকেন বা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন। কুনার প্রদেশের আন্দারলুকাক গ্রামের ১৯ বছর বয়সী একজন বেঁচে যাওয়া মহিলা, বিবি আয়শা, নিউ ইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন, “তারা আমাদের এক কোণে জড়ো করে ভুলে গিয়েছিল।” তিনি বলেন, কিছু মহিলা রক্তক্ষরণের মধ্যেও কোনো সাহায্য পাননি, কেউ তাদের প্রয়োজন জানতে চায়নি বা তাদের কাছে এগিয়ে আসেনি। আয়শার গ্রামে উদ্ধারকারী দল ৩৬ ঘণ্টা পরে পৌঁছালেও, তাদের মধ্যে কোনো মহিলা ছিল না, যা মহিলাদের উদ্ধারকে আরও জটিল করে তুলেছিল।

   

কুনার প্রদেশের মাজার দারায় স্বেচ্ছাসেবক তাহজীবুল্লাহ মুহাজেব জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ পুরুষ উদ্ধারকারী দল মহিলাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করতে দ্বিধা করছিল। তিনি বলেন, “মহিলারা যেন অদৃশ্য ছিল। পুরুষ এবং শিশুদের প্রথমে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু মহিলারা আলাদা বসে সেবার জন্য অপেক্ষা করছিল।” কিছু ক্ষেত্রে, পুরুষ আত্মীয় না থাকলে, মৃত মহিলাদের দেহ কাপড় ধরে টেনে বের করা হয়েছিল, যাতে সরাসরি স্পর্শ এড়ানো যায়। এই পরিস্থিতি মহিলাদের প্রতি বৈষম্য এবং অবহেলার একটি করুণ চিত্র তুলে ধরে।

মহিলা চিকিৎসকের অভাব এবং শিক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞা
তালিবানের ২০২৩ সালের মহিলাদের চিকিৎসা শিক্ষায় ভর্তির উপর নিষেধাজ্ঞা দেশে মহিলা চিকিৎসক এবং উদ্ধারকারীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে গ্রামীণ এলাকায় মহিলাদের চিকিৎসা প্রদান করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের একজন সাংবাদিক মাজার দারায় গিয়ে দেখেছেন, সেখানে কোনো মহিলা চিকিৎসা বা উদ্ধারকারী দলে ছিল না। একটি জেলা হাসপাতালে কোনো মহিলা কর্মী ছিল না। তালিবান-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শরাফত জামান স্বীকার করেছেন, ভূমিকম্প-আক্রান্ত এলাকায় মহিলা চিকিৎসকের অভাব রয়েছে, তবে তিনি দাবি করেছেন যে কুনার, নঙ্গারহার এবং লাঘমান প্রদেশের হাসপাতালে “সর্বাধিক সংখ্যক মহিলা চিকিৎসক এবং নার্স” কাজ করছেন।

তালিবানের নিয়ম অনুসারে, শুধুমাত্র একজন মহিলার নিকটাত্মীয় পুরুষ—তার বাবা, ভাই, স্বামী বা ছেলে—তাকে স্পর্শ করতে পারে। একইভাবে, মহিলারা তাদের পরিবারের বাইরের পুরুষদের স্পর্শ করতে পারে না। এই নিয়মের ফলে, দুর্যোগ কবলিত এলাকায় মহিলা উদ্ধারকারীরা পুরুষদের সাহায্য করতে পারে না, তবে মহিলারা অন্য মহিলাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করতে পারে। কিন্তু মহিলা উদ্ধারকারীর অভাব এই প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে।

মহিলাদের প্রতি বৈষম্য এবং মানবাধিকার উদ্বেগ
জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা তালিবানের লৈঙ্গিক নীতির জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা জরুরি পরিস্থিতিতে মহিলাদের কষ্টকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। ইউএন উইমেন আফগানিস্তানের বিশেষ প্রতিনিধি সুসান ফার্গুসন বলেছেন, “মহিলা এবং কন্যারা এই দুর্যোগের প্রধান ভুক্তভোগী হবে, তাই তাদের প্রয়োজনীয়তাগুলিকে প্রতিক্রিয়া এবং পুনরুদ্ধারের কেন্দ্রে রাখতে হবে।” তিনি মহিলা মানবিক কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উপর জোর দিয়েছেন, যাতে জীবন রক্ষাকারী সহায়তা মহিলা ও কন্যাদের কাছে পৌঁছায়।

Advertisements

তালিবান সরকার নিহতদের লৈঙ্গিক বিভাজন প্রকাশ করেনি, তবে ভূমিকম্প-আক্রান্ত এলাকার একাধিক চিকিৎসক, উদ্ধারকারী এবং মহিলাদের সাক্ষাৎকারে জানা গেছে, মহিলারা বিশেষভাবে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেক মহিলা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন বা চিকিৎসা না পেয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে, মহিলাদের উদ্ধারের জন্য পার্শ্ববর্তী গ্রামের অপরিচিত মহিলাদের উপর নির্ভর করতে হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় মহিলাদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা

এই ভূমিকম্প তালিবান-শাসিত আফগানিস্তানে মহিলাদের প্রতি বৈষম্যের একটি করুণ চিত্র তুলে ধরেছে। ২০২৩ সালে হেরাত প্রদেশে সংঘটিত ভূমিকম্পে নিহতদের প্রায় ৬০% এবং আহতদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ছিল মহিলা। এই সংখ্যাগুলি দেখায় যে, তালিবানের নিয়ম এবং সাংস্কৃতিক বিধিনিষেধ মহিলাদের জন্য দুর্যোগের প্রভাবকে আরও মারাত্মক করে তুলছে। মহিলারা বাড়িতে থাকার কারণে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ার ঝুঁকি বেশি, এবং অনেকে বাধ্যতামূলক হিজাব পরতে গিয়ে পালানোর সময় নষ্ট করেন, যা তাদের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

জাতিসংঘ এবং মানবিক সংস্থাগুলি লৈঙ্গিক-সংবেদনশীল দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে। মহিলাদের শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া এবং মহিলা চিকিৎসক ও উদ্ধারকারীদের সংখ্যা বাড়ানোর মাধ্যমে এই ধরনের দুর্যোগে মহিলাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ানো সম্ভব। তবে, তালিবানের কঠোর নীতি এই প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে।

আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ভূমিকম্প শুধুমাত্র একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং তালিবানের লৈঙ্গিক বৈষম্যমূলক নীতির ফলে মহিলাদের জন্য একটি মানবসৃষ্ট বিপর্যয় হয়ে উঠেছে। মহিলাদের চিকিৎসা শিক্ষা এবং পাবলিক সেক্টরে কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা, পুরুষ উদ্ধারকারীদের মহিলাদের স্পর্শ করতে নিষেধ করা এবং সাংস্কৃতিক বিধিনিষেধ মহিলাদের জীবন রক্ষাকারী সহায়তা থেকে বঞ্চিত করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই সংকট মোকাবেলায় তালিবানের উপর চাপ সৃষ্টি করা এবং মহিলাদের জন্য সমান ত্রাণ ও চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা। মহিলা ও কন্যাদের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং মহিলা মানবিক কর্মীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে আফগানিস্তানে দুর্যোগ প্রতিক্রিয়াকে আরও কার্যকর করা সম্ভব।