রিও ডি জেনিরোতে পুলিশের রক্তক্ষয়ী অভিযান, নিহতের সংখ্যা ১০০ ছাড়াল

Rio de Janeiro police raid 2025 Comando Vermelho deaths

রিও ডি জেনিরো, ২৭ অক্টোবরঃ লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় শহরগুলির একটি রিও ডি জেনিরো (Rio de Janeiro) আবারও রক্তে ভিজল। ব্রাজিলের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মাদকচক্র কমান্ডো ভেরমেলো (Comando Vermelho)-র বিরুদ্ধে পুলিশের চালানো এক বিশাল অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১১৯ জন মানুষ। মঙ্গলবার রাত থেকে শুরু হওয়া এই অভিযান একদিনের মধ্যেই রিওকে পরিণত করেছে কার্যত যুদ্ধক্ষেত্রে।

Advertisements

সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত নিহতদের মধ্যে রয়েছে ১১৫ জন সন্দেহভাজন গ্যাং সদস্য এবং ৪ জন পুলিশ কর্মী। তবে স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা ও রাজ্যের পাবলিক ডিফেন্ডারস অফিস দাবি করছে, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি, যা ১৩২ জনের কাছাকাছি।

   

পরিবার ও স্থানীয়দের অভিযোগ: ‘এটা অভিযান নয়, গণহত্যা’

অভিযানের পরের দিন সকালেই Complexo da Penha নামক ফাভেলার রাস্তায় একে একে সাজানো হচ্ছিল মৃতদেহ। অনেকের শরীরে ছিল আগুনে পোড়া দাগ, কারও মাথা ছিল ছিন্নভিন্ন, আবার কারও শরীরে পিছন দিক থেকে গুলি চালানোর চিহ্ন।

এক শোকার্ত মহিলা বলেন, “রাষ্ট্র মানুষকে রক্ষা করতে আসেনি, হত্যা করতে এসেছে। এটা কোনও নিরাপত্তা অভিযান নয়, সরাসরি গণহত্যা।”

স্থানীয় এক আইনজীবী, যিনি তিনটি মৃত পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করছেন, জানান, নিহতদের মধ্যে অনেককে হাত বেঁধে হত্যা করা হয়েছে। অনেকের শরীরে গুলি করার পাশাপাশি ‘কোল্ড ব্লাডেড’ এক্সিকিউশনের স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।

পুলিশের যুক্তি: ‘নিরাপত্তার জন্য বড় পদক্ষেপ’

রাজ্যের গভর্নর ক্লাউদিও কাস্ত্রো এই অভিযানের প্রশংসা করেছেন এবং এটিকে “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সাফল্য” বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর দাবি, নিহতরা মূলত মাদকচক্রের সক্রিয় সদস্য, যারা পুলিশের উপর হামলা চালিয়েছিল।

অভিযান চলাকালীন গ্যাং সদস্যরা শহরের প্রধান সড়কগুলোতে ডজনখানেক বাস জ্বালিয়ে ও ব্যারিকেড বসিয়ে পরিবহণ ব্যবস্থা অচল করে দেয়। আরও ভয়ঙ্করভাবে তারা ড্রোনের মাধ্যমে পুলিশকে বোমা মেরে আক্রমণ চালায়।

পুলিশের দাবি, এই গ্যাং দীর্ঘদিন ধরে রিওর বড় বড় ফাভেলাগুলি দখল করে রেখেছিল এবং স্থানীয়দের আতঙ্কের মধ্যে রাখছিল।

Advertisements

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও জাতিসংঘের উদ্বেগ

এই রক্তক্ষয়ী অভিযানের খবর পৌঁছেছে জাতিসংঘ পর্যন্ত। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দফতর একে “ভয়াবহ” বলে অভিহিত করেছে এবং দ্রুত তদন্তের দাবি তুলেছে।

স্থানীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধান দানী মন্টেইরো প্রশ্ন তুলেছেন— “কীভাবে একটি আবাসিক এলাকা রাতারাতি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হল? এখানে নিরাপত্তা নয়, বর্বরতার চিত্র ফুটে উঠেছে।”

লুলা সরকারের অস্বস্তি

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা এই ঘটনার পর হতবাক হয়ে পড়েছেন। বিচারমন্ত্রী রিকাডো লেওয়ানডোভস্কি জানিয়েছেন, লুলা সরকার এই অভিযানের বিষয়ে পূর্বে অবগতই ছিল না। তাঁর কথায়, “রাষ্ট্রপতি এত প্রাণহানির ঘটনায় আতঙ্কিত ও বিস্মিত। ফেডারেল সরকারকে না জানিয়েই এতো বড় অভিযান চালানো হয়েছে।”

উল্লেখযোগ্যভাবে, এই ঘটনার মাত্র কয়েকদিন পরেই ব্রাজিলে শুরু হতে চলেছে আন্তর্জাতিক COP30 জলবায়ু সম্মেলন। ফলে বিশ্বদরবারে এই রক্তক্ষয়ী অভিযান লুলা সরকারের ভাবমূর্তি বিপন্ন করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

রিও ডি জেনিরোতে পুলিশ ও গ্যাংদের সংঘর্ষ নতুন কিছু নয়। গত বছরই প্রায় ৭০০ জন মানুষ পুলিশের অভিযানে মারা গিয়েছিল— গড়ে প্রতিদিন প্রায় দু’জন। কিন্তু এবারের অভিযান ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ।

একদিকে রাষ্ট্র বলছে এটি নিরাপত্তার জন্য জরুরি পদক্ষেপ, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ একে দেখছেন ‘গণহত্যা’ হিসেবে। যেভাবেই হোক, রিওর বস্তিগুলোতে আতঙ্ক, ক্ষোভ ও শোক এখন একসঙ্গে বিরাজ করছে।

ব্রাজিল ও বিশ্বের সামনে এখন বড় প্রশ্ন—এই অভিযান কি সত্যিই অপরাধ দমনে সাফল্য আনবে, নাকি মানবাধিকারের নামে এক নতুন কলঙ্ক লিখে দেবে ইতিহাসে?