চিনের মাটিতে প্রথম সফরে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে লাল কার্পেট অভ্যর্থনা

শনিবার চীনের তিয়ানজিন শহরে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO Summit) সম্মেলনে যোগ দিতে দুই দিনের সরকারি সফরে পৌঁছালেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিয়ানজিনের বিনহাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে…

PM Modi arrives in Tianjin, China for two-day visit to attend SCO Summit

শনিবার চীনের তিয়ানজিন শহরে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO Summit) সম্মেলনে যোগ দিতে দুই দিনের সরকারি সফরে পৌঁছালেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিয়ানজিনের বিনহাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর তাঁকে স্বাগত জানান ভারতের প্রতিনিধি দল এবং চীনের শীর্ষ সরকারি আধিকারিকরা। উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানোর অংশ হিসেবে সাংস্কৃতিক শিল্পীরা ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশন করেন।

এই সফরের মূল লক্ষ্য হল এসসিও সম্মেলনে অংশগ্রহণ এবং পার্শ্ববৈঠকের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক আলোচনার সূচনা করা। জানা গিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী মোদী চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে বৈঠক করবেন। পাশাপাশি, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও বৈঠক নির্ধারিত রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই বৈঠকগুলো ভারতের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হতে চলেছে।

   

এসসিও সম্মেলন শুরু হচ্ছে এমন সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক সরাসরি আরোপিত হয়েছে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানির কারণে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই পদক্ষেপ ভারতের জ্বালানি নীতি এবং বাণিজ্যিক ভারসাম্যের উপর বড়সড় প্রভাব ফেলতে পারে। তাই মোদী–পুতিন বৈঠকে জ্বালানি সহযোগিতা এবং তেল আমদানি প্রসঙ্গ গুরুত্ব পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন বর্তমানে ১০টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত— ভারত, বেলারুশ, চীন, ইরান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, পাকিস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান এবং উজবেকিস্তান। এর পাশাপাশি কয়েকটি দেশ পর্যবেক্ষক ও সংলাপ সহযোগী হিসেবে যুক্ত রয়েছে।
ভারত ২০০৫ সালে এসসিও-তে পর্যবেক্ষক সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছিল এবং ২০১৭ সালে পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে। গত কয়েক বছরে ভারত

একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে— যেমন ২০২০ সালে এসসিও কাউন্সিল অফ হেডস অফ গভর্নমেন্ট-এর চেয়ারম্যানশিপ এবং ২০২২ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত এসসিও কাউন্সিল অফ হেডস অফ স্টেট-এর সভাপতিত্ব।

বিশ্লেষকদের মতে, এসসিও শুধুমাত্র আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার একটি মঞ্চ নয়, বরং পশ্চিমা জোটগুলির ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রেও তা বড় ভূমিকা পালন করে। ভারতের জন্য এই মঞ্চে সক্রিয় উপস্থিতি মানে মধ্য এশিয়া, রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা।

Advertisements

২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর এটাই হবে প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রথম চীন সফর। সেই সংঘর্ষের পর দুই দেশের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে সাম্প্রতিক কয়েক মাসে নয়াদিল্লি এবং বেইজিং উভয়ই সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— উত্তরাখণ্ডের লিপুলেখ পাস, হিমাচলের শিপকি লা এবং সিকিমের নাথু লা দিয়ে সীমান্ত বাণিজ্য পুনরায় চালু করা।

এছাড়া, চলতি বছরের ১৮-১৯ আগস্ট চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর ভারত সফরে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়। দুই দেশ সম্মত হয় দ্রুততম সময়ে ভারত-চীন সরাসরি বিমান পরিষেবা পুনরায় চালু করতে এবং নতুন এয়ার সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্ট চূড়ান্ত করতে। একইসঙ্গে পর্যটক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক এবং অন্যান্য ভ্রমণকারীদের জন্য ভিসা প্রদানের প্রক্রিয়া সহজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ভারত ও চীন উভয়েই বৈঠকে বহুপাক্ষিকতাকে সমর্থন করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। তারা জানিয়েছে, বড় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে যোগাযোগ বাড়ানো হবে এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-কেন্দ্রিক নিয়মভিত্তিক বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ণ রাখা হবে। পাশাপাশি, একটি বহু-মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করা হয়েছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলির স্বার্থ রক্ষা করবে।

১. অর্থনৈতিক সহযোগিতা: ভারত-চীন বাণিজ্যের ভারসাম্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এই বিষয়টিতে নতুন উদ্যোগের সম্ভাবনা খোঁজা হবে।
২. জ্বালানি নিরাপত্তা: রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানির প্রসঙ্গ ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুতিনের সঙ্গে মোদীর বৈঠকে বিকল্প পেমেন্ট মেকানিজম এবং ছাড়কৃত দামে তেল সরবরাহের বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
৩. নিরাপত্তা ও সীমান্ত স্থিতিশীলতা: গালওয়ানের ঘটনার পর সীমান্তে শান্তি বজায় রাখা এবং ভবিষ্যতে সংঘাত এড়াতে আরও কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
৪. পর্যটন ও সাংস্কৃতিক বিনিময়: দুই দেশের জনগণের মধ্যে সংযোগ বাড়াতে সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি এবং পর্যটন ভিসা সহজীকরণের ওপর জোর দেওয়া হবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এসসিও সম্মেলন ভারতের জন্য একদিকে যেমন চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার সুযোগ এনে দিচ্ছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক টানাপড়েনের প্রেক্ষাপটে একধরনের কৌশলগত ভারসাম্য তৈরি করার পথও খুলে দিচ্ছে। বিশেষত, ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এই সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘোরাতে পারে।