পাকিস্তানের জাতীয় বিমান সংস্থা পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (PIA) অবশেষে নিলামে উঠতে চলেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) আর্থিক সহায়তার শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে পিআইএ-র ৫১-১০০% শেয়ার বিক্রি করছে পাকিস্তান সরকার। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ নিশ্চিত করেছেন, পিআইএ-র বিডিং প্রক্রিয়া ২০২৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে এবং তা সকল মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। দীর্ঘদিন ধরে ঋণ ও অনুদানের ওপর টিকে থাকা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ‘ফিসকাল প্রুডেন্স’-এর পথে ফেরাতে আইএমএফ এই বেসরকারিকরণের শর্ত দিয়েছে।
আইএমএফের বেইলআউটের মূল শর্ত
পিআইএ-র শেয়ার বিক্রি ইসলামাবাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আইএমএফের $৭ বিলিয়ন আর্থিক প্যাকেজের অন্যতম প্রধান শর্ত। এই বেসরকারীকরণ গত দুই দশকে পাকিস্তানের প্রথম বড় আকারের বেসরকারিকরণের প্রচেষ্টা। পাকিস্তানের বেসরকারিকরণ মন্ত্রী মুহম্মদ আলি রয়টার্সকে জানিয়েছেন, এই বছর বেসরকারিকরণ থেকে তাদের লক্ষ্যমাত্রা ৮৬ বিলিয়ন পাকিস্তানি রুপি। তিনি আরও জানান, “পিআইএ-র শেষ বিডিং-এ ১৫% অর্থ সরকারের কাছে যাচ্ছিল, বাকিটা কোম্পানির কাছেই থাকত।”
নিলামে সামরিক-নিয়ন্ত্রিত সংস্থার অংশগ্রহণ PIA Sale IMF Condition Pakistan
পিআইএ বিক্রির জন্য চারটি সংস্থা প্রাক-যোগ্যতা অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে-
১. লাকি সিমেন্ট কনসোর্টিয়াম (Lucky Cement Consortium) ২. আরিফ হাবিব কর্পোরেশন কনসোর্টিয়াম (Arif Habib Corporation Consortium) ৩. ফৌজি ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (Fauji Fertiliser Company Limited) ৪. এয়ার ব্লু লিমিটেড (Air Blue Limited)
এই বিডারদের মধ্যে ফৌজি ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটি সামরিক-নিয়ন্ত্রিত ফৌজি ফাউন্ডেশনের অংশ। ফৌজি ফাউন্ডেশন পাকিস্তানের অন্যতম বৃহৎ কর্পোরেট খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে সামরিক বাহিনীর ব্যাপক প্রভাবকে স্পষ্ট করে।
বর্তমানে পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি, ফিল্ড মার্শাল আসিফ মুনির, সরাসরি ফৌজি ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় বোর্ড অফ ডিরেক্টরসে (CBDs) না থাকলেও, তিনি কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেলকে (QMG) নিয়োগ করেন, যিনি এই বোর্ডের সদস্য। সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে মুনির এভাবে ফৌজি ফাউন্ডেশনের ওপর পরোক্ষ প্রভাব বজায় রাখেন।
পিআইএ সংকটের নেপথ্যে: পাইলট কেলেঙ্কারি ও অব্যবস্থা
পিআইএ-র বেহাল অবস্থার মূল কারণ বহু বছরের আর্থিক অব্যবস্থা, যা পাকিস্তানকে ঋণের বোঝা আরও বাড়িয়েছে। পিআইএ সংকট তীব্র হয় ২০২০ সালে, যখন প্রকাশিত হয় যে ৩০% এরও বেশি পাকিস্তানি পাইলট ভুয়া বা প্রশ্নবিদ্ধ লাইসেন্স নিয়ে বিমান চালাচ্ছিলেন। এই কেলেঙ্কারির ফলে ২৬২ জন পাইলটকে গ্রাউন্ডেড করতে হয়।
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা: ২০২০ সালের জুনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এভিয়েশন সেফটি এজেন্সি (EASA) পিআইএ-র ইউরোপীয় রুটে উড়ানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। একই কারণে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রও নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এর ফলে বিমান সংস্থাটি বার্ষিক শত শত কোটি রুপি আয় থেকে বঞ্চিত হয় এবং তার বৈশ্বিক সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি: বছরের পর বছর ধরে চলা অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ, রাজনৈতিক নিয়োগ এবং চরম স্বজনপ্রীতি পিআইএ-কে শিল্প মানদণ্ডের তুলনায় অনেক বড় কর্মী বাহিনীতে পরিণত করে। কর্মীদের বেতন ও সুবিধা বাবদ বিপুল ব্যয় এবং অদক্ষতা কেলেঙ্কারির পর আর্থিক ক্ষতিকে পিকেআর ২০০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যেতে সাহায্য করে।
নিরাপত্তা ত্রুটি: ২০২০ সালে পিআইএ ফ্লাইট ৮৩০৩-এর ভয়াবহ দুর্ঘটনাটিই পাইলট-লাইসেন্স তদন্ত শুরু করতে বাধ্য করে। এই দুর্ঘটনার জেরে ব্যয়বহুল ফ্লিট পরিদর্শন, গ্রাউন্ডিং এবং মেরামত করতে হয়, যা নগদ অর্থের তীব্র অভাব থাকা সংস্থাটির উপর আরও চাপ সৃষ্টি করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পিআইএ কেবল পাকিস্তানের জাতীয় বিমান সংস্থাই নয়, এর পতনের গল্পটি বহুলাংশে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যার প্রতিফলন। একক কোনো কেলেঙ্কারিতে নয়, বরং বছরের পর বছর ধরে চলা পদ্ধতিগত ব্যর্থতার ধারাবাহিক শৃঙ্খলে পিআইএ-র এই করুণ দশা।
