বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস (Muhammad Yunus) আজ ইউরোপীয় দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছেন যে, তারা তাদের ভিসা কেন্দ্রগুলো (EU visa centers) দিল্লি থেকে ঢাকায় অথবা অন্য কোন পার্শ্ববর্তী দেশে স্থানান্তরিত করুক।
ভারতের ভিসা নিষেধাজ্ঞা
তিনি বলেন, “ভারতের ভিসা নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেক বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রী দিল্লি এসে ইউরোপীয় ভিসা নিতে পারছেন না, যার ফলে তাদের শিক্ষার উপর অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। এর ফলে ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঢাকা বা পার্শ্ববর্তী দেশে ভিসা অফিস স্থানান্তর করলে তা বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্যই উপকারী হবে।”
এ প্রসঙ্গে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা তোহিদ হোসেন আরও যোগ করেন, “বুলগেরিয়া ইতোমধ্যে বাংলাদেশী আবেদনকারীদের জন্য তার ভিসা কেন্দ্র ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনামে স্থানান্তরিত করেছে। তিনি অন্যান্য দেশগুলোকে এই পদক্ষেপ অনুসরণের আহ্বান জানান।”
ইউনুসের ইউরোপীয় কূটনীতিকদের সাথে বৈঠক
অধ্যাপক ইউনুস আজ ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোর কূটনীতিকদের সাথে এক বৈঠকে এই আহ্বান জানান। এ বৈঠকটি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে তেজগাঁওয়ে দুপুরে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯ সদস্যবিশিষ্ট এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন মাইকেল মিলার, বাংলাদেশের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের অ্যাম্বাসাডর এবং প্রধান প্রতিনিধি।
বৈঠকে আলোচিত বিষয়গুলো
বৈঠকে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, যেমন শ্রম অধিকার, বাণিজ্য সুবিধা, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং ভবিষ্যতের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি।
অধ্যাপক ইউনুস তার বক্তব্যে গত ১৫ বছরে দেশে সংঘটিত দমন-পীড়ন, শোষণ, গুম, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলি সংক্ষেপে তুলে ধরেন। তিনি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রতিবেদন উপস্থাপনের আহ্বান জানান, যাতে দুর্নীতি, অর্থ পাচার এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটানোর বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।
ইউনুসের রাজনৈতিক ঐক্যের আহ্বান
অধ্যাপক ইউনুস দেশের জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারেও বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, “আমি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেছি, যাতে সামাজিক ঐক্য এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা যায়।”
ইইউ কূটনীতিকদের সমর্থন
এদিকে, বৈঠকে উপস্থিত ইউরোপীয় কূটনীতিকরা বাংলাদেশের বর্তমান সংস্কার উদ্যোগগুলোর পূর্ণ সমর্থন জানান। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য পরামর্শ এবং সমাধান প্রদান করেন। বৈঠক শেষে বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্য একত্রে কাজ করার প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়।
বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক
বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে একযোগ কাজ করার আশা প্রকাশ করা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, মানবাধিকার এবং শ্রম অধিকার বিষয়ক উদ্যোগে ইইউ সহযোগিতা আরও বাড়ানোর কথা বলেছেন।
এছাড়াও, বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের বাজারে ইউরোপীয় পণ্য প্রবাহ বাড়ানোর জন্য একত্রে কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দুই পক্ষের মধ্যে মতবিনিময় এবং সহযোগিতার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা
অধ্যাপক ইউনুস বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের উন্নয়ন এক দীর্ঘ যাত্রা। দেশের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে কাজ করতে হবে, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য, দেশের প্রতিটি সেক্টরে উন্নতি করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ইউরোপীয় দেশগুলোর সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে সহায়তা চেয়েছেন।
ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া
ইউরোপীয় কূটনীতিকরা বাংলাদেশের এই পদক্ষেপে সমর্থন জানিয়ে বলেন, তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগে সহায়তা দিতে প্রস্তুত। তারা বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার, নারী ও শিশুদের সুরক্ষা, এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন। এ বৈঠকে দুই পক্ষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বিষয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এই বৈঠকের মাধ্যমে। জাতীয় ঐক্য, মানবাধিকার, এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে একসাথে কাজ করার মাধ্যমে দু’পক্ষ ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই এবং সমৃদ্ধ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।