ঢাকা: ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেই নতুন কূটনৈতিক সুযোগ খুঁজে নিচ্ছে ইসলামাবাদ। ঠিক এমন সময়ে, ঢাকাকে আকৃষ্ট করতে পাকিস্তান প্রস্তাব দিয়েছে করাচি বন্দর ব্যবহারের সুবিধা, বিশেষত বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে।
সোমবার ঢাকায় পাকিস্তান–বাংলাদেশ যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (JEC) বৈঠকে এই প্রস্তাব সামনে আসে, দুই দশক পর এমন বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া নিজেই একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এতে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সম্পর্কের পুনরুজ্জীবনের ইঙ্গিত মিলছে—যে দেশটির বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশ।
করাচি বন্দরের প্রস্তাব ও তার তাৎপর্য
ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের সুযোগ নিয়ে পাকিস্তান এবার ঢাকাকে করাচি বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিতে চায়—যাতে বাংলাদেশ চিন, উপসাগরীয় অঞ্চল ও মধ্য এশিয়ার বাজারে রপ্তানি বাড়াতে পারে।
তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, এই সমুদ্রপথ অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর নয়—২৬০০ নটিক্যাল মাইল দীর্ঘ এই রুটে পণ্য পৌঁছাতে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় লাগে, ফলে খরচও বেড়ে যায়।
এই প্রেক্ষিতে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি মূলত প্রতীকী পদক্ষেপ, ভারতের ওপর ভূরাজনৈতিক চাপ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে।
এর পাশাপাশি পাকিস্তান বাংলাদেশি পাটজাত পণ্যের ওপর শুল্ক ছাড় দিয়েছে এবং আমদানিতে কর হ্রাস করেছে। আগে থেকেই ২% কাস্টমস ডিউটি প্রত্যাহার করেছিল ইসলামাবাদ। ফলে পাট ও বস্ত্রশিল্পে বাংলাদেশকে নতুন বাজার সুবিধা দেওয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট।
জুট, আম ও বাণিজ্যিক সমীকরণ Karachi Port Offer Bangladesh Jute
পাকিস্তানি এক কর্মকর্তা ‘ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস বাংলাদেশ’-কে জানিয়েছেন, “পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটজাত পণ্য আমদানিতে আগ্রহী, অন্যদিকে বাংলাদেশও পাট রফতানির বাজার বাড়াতে চায়।”
অন্যদিকে, ইসলামাবাদ বাংলাদেশে পাকিস্তানি আমের বাজার প্রবেশাধিকার দ্রুততর করতে চেয়েছে, কারণ ভারতের আম রফতানি কমায় এই ক্ষেত্রে শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক প্রায় ৮৬৫ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়, যার মধ্যে ৭৭৮ মিলিয়ন ডলারই পাকিস্তানের রফতানি। বাংলাদেশের রফতানির ৩৮% জুড়ে আছে পাটজাত পণ্য।
ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সংকটের পটভূমি
পাকিস্তানের এই ‘বাণিজ্যিক উষ্ণতা’র পটভূমিতে রয়েছে ভারতের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ- আগস্টে ভারত বাংলাদেশি পাট ও দড়িজাত পণ্যের স্থলপথে আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। এর আগেই বোনা কাপড় ও পোশাকের আমদানি স্থলপথে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, এখন সেগুলি কেবল নভি মুম্বাইয়ের নাহাভা শেভা সমুদ্রবন্দর দিয়ে প্রবেশ করতে পারে, যা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে অকার্যকর।
ফলে সমুদ্রপথে রফতানি বাড়লেও খরচও আকাশচুম্বী হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভারতের ট্রানশিপমেন্ট চুক্তি বাতিল, যার ফলে বাংলাদেশি পণ্য ভারতের বন্দর ঘুরে অন্য দেশে পাঠানোও বন্ধ হয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের এই সিদ্ধান্তের পরে বাংলাদেশের পাট রফতানি আয় জুলাই মাসে ১২.৯ মিলিয়ন ডলার থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে ৩.৪ মিলিয়নে। এর জবাবে ঢাকা পাঁচটি স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের সুতা আমদানি বন্ধ করেছে।
ভূরাজনৈতিক পালাবদল
ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি শুরু হয় ২০২৪ সালের অগাস্ট মাসে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর। প্রায় পনেরো বছর ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র থাকা হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে, এবং এরপর থেকেই ঢাকা নতুনভাবে পাকিস্তান ও চিনের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করতে শুরু করে। পাকিস্তানও দ্রুত সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে চাইছে—করাচি বন্দরের প্রস্তাব তারই কূটনৈতিক ইঙ্গিত।


