আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ–র প্রাক্তন কর্মকর্তা জেমস ল’লার পাকিস্তানের বিতর্কিত পরমাণু বিজ্ঞানী এ কিউ খান এবং তাঁর বৈশ্বিক পারমাণবিক পাচার নেটওয়ার্ক নিয়ে বিস্ফোরক দাবি করেছেন। ANI-কে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ল’লার তাঁর গোয়েন্দা জীবন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অপারেশন এবং দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের পারমাণবিক নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বহু অজানা তথ্য তুলে ধরেন। তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে—এ কিউ খানের নেটওয়ার্ক শুধু পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচি শক্তিশালী করেনি, বরং বিশ্বজুড়ে বিপজ্জনক রাষ্ট্রগুলোর কাছে গোপনে প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। এ জন্য ল’লার তাঁকে ডাকতেন—“Merchant of Death”।
সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, খানের পাচার নেটওয়ার্ককে কয়েকজন পাক জেনারেল ও রাজনৈতিক নেতা ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করেছিলেন। তাঁর ভাষায়—
“AQ Khan had certain Pakistani generals and leaders on his payroll. তবে এটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক নীতি ছিল না।”
এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে, কারণ এতদিন পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে এ কিউ খানের কর্মকাণ্ডকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগ বলে দাবি করে এসেছে।
জেমস ল’লারের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৯৮০-এর দশক থেকে সিআইএ খানকে পর্যবেক্ষণ করছিল। প্রথমদিকে তাঁরা ভেবেছিলেন, তাঁর কার্যকলাপ শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরমাণু প্রকল্পের জন্যই প্রযুক্তি সংগ্রহ করছে। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে এসে স্পষ্ট হয়, খান নিজেই একটি বৈশ্বিক নিউক্লিয়ার ট্রাফিকিং নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন, যার ক্লায়েন্ট তালিকায় ছিল—
- ইরান
- লিবিয়া
- উত্তর কোরিয়া
- এবং মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার আরও কিছু গোপন কর্মসূচি
ল’লার জানান, সিআইএ দীর্ঘ সময় পরে বুঝতে পেরেছিল যে খান আড়ালে “বিক্রেতা” হয়ে উঠেছেন। তাঁর নিজের ভাষা—
“We were slow to understand he was becoming an outward proliferator.”
এ কিউ খানের কার্যক্রম চিহ্নিত করতে ল’লার একটি উদ্ভাবনী কৌশল গ্রহণ করেন। তিনি Felix Dzerzhinsky-র খ্যাতনামা “Trust” অপারেশন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একাধিক ভুয়া বিদেশি কোম্পানি তৈরি করেন, যেগুলি দেখতে পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহকারী সংস্থার মতো। এভাবে সিআইএ পাচার নেটওয়ার্কের ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।
ল’লারের ভাষায়—
“If I want to defeat proliferators, I need to become a proliferator.”
এই ভুয়া সংস্থাগুলির মাধ্যমে তাঁরা এমন সরঞ্জাম পাঠাতেন, যা ইচ্ছাকৃতভাবে ত্রুটিপূর্ণ বা দুর্বল করা থাকত, ফলে সংশ্লিষ্ট দেশের পারমাণবিক কর্মসূচির বড় ক্ষতি হতো। ল’লার বলেন—
“We took the reverse of the Hippocratic oath. We always did harm.”
লিবিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচিকে দুর্বল করার ক্ষেত্রে সিআইএ–র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব ছিল BBC China নামের একটি জাহাজ আটকানো। তাতে পাওয়া যায় “শত-হাজার” পারমাণবিক কম্পোনেন্ট।
ল’বলার বলেন—যখন এই প্রমাণ লিবিয়ার কর্মকর্তাদের দেখানো হয়, “You could have heard a pin drop”। লিবিয়া পরে স্বেচ্ছায় তাদের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়।
সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিও অনেকটাই গড়ে উঠেছিল এ কিউ খানের নেটওয়ার্ক থেকে পাওয়া P1 ও P2 সেন্ট্রিফিউজ প্রযুক্তির ওপর। এমনকি তাঁরা একটি চীনা অ্যাটমিক বোমার নীলনকশাও সরবরাহ করেছিলেন বলে দাবি করেন ল’লার। তাঁর সতর্কবার্তা—ইরান পরমাণু অস্ত্র পেলে মধ্যপ্রাচ্যে “nuclear pandemic” শুরু হতে পারে, যার ফলে একাধিক দেশ দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে নেমে পড়বে।
পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে মার্কিন নীতি কেন তুলনামূলকভাবে নমনীয় ছিল—এই প্রশ্নে ল’বলার বলেন, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থই তখন মুখ্য ছিল। তিনি স্বীকার করেন—ওয়াশিংটন কখনো কখনো “blind eye” দেখিয়েছিল, যার দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি আজও বিশ্বের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
৯/১১–এর পর সিআইএ খানের ওপর নজরদারি আরও বাড়ায়, কারণ আশঙ্কা ছিল—আল-কায়েদা বা অন্য কোনো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর কাছে তিনি পারমাণবিক উপাদান সরবরাহ করতে পারেন। সিআইএ ডিরেক্টর জর্জ টেনেট ব্যক্তিগতভাবে পারভেজ মোশারফকে খানের বিরুদ্ধে তথ্য দেখিয়েছিলেন বলেও ল’বলার সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন।
নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ল’বলার বলেন—তিনি কোনো অনুশোচনা অনুভব করেন না। তাঁর কাজ ছিল বৈশ্বিক পারমাণবিক ঝুঁকি কমানো। বর্তমানে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে স্পাই থ্রিলার উপন্যাস লেখেন—সবকটিই সিআইএ–র রিভিউ বোর্ড দ্বারা অনুমোদিত।
