‘মুসলমানরা রাগ করবে’ বলে আমায় তাড়িয়েছিলেন বুদ্ধবাবু, তসলিমা লিখলেন ‘লাল সালাম’

ধর্মীয় মৌলবাদের বিপক্ষে লিখে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হয়েছেন তসলিমা নাসরিন। তিনি ভারত ও ফ্রান্সের রাজনৈতিক আশ্রয়ে। নিজ দেশ থেকে নির্বাসনের পর কলকাতায় থাকতেন। পশ্চিমবঙ্গের ততকালীন…

ধর্মীয় মৌলবাদের বিপক্ষে লিখে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হয়েছেন তসলিমা নাসরিন। তিনি ভারত ও ফ্রান্সের রাজনৈতিক আশ্রয়ে। নিজ দেশ থেকে নির্বাসনের পর কলকাতায় থাকতেন। পশ্চিমবঙ্গের ততকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (Buddhadeb Bhattacharjee)। তাঁর প্রয়াণ হয়েছে ৮ আগস্ট। প্রয়াণ দিবসে তসলিমা নাসরিন লিখছেন তাঁর সাথে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর (Buddhadeb Bhattacharjee) অম্ল-মধুর স্মৃতি।

ফেসবুকে নির্বাসিত লেখিকার পোস্ট:

   

“বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মারা গেছেন। খবরটি একজন দিল সকালে। শেষদিকে তাঁর কষ্টের মাত্রা খুব বেশি ছিল। এও বললো। ২০০৩ সালের আগে এরকম খবর শুনলে আমি হয়তো চোখের জল ফেলতাম। কিন্তু তিনি আমার চোখের জল অনেক বছর ঝরিয়েছেন , তিনি বেঁচে থাকাকালীন। তাই চোখ থেকে আজ কোনও জল ঝরলো না তাঁর জন্য। আসলে কোনও জল আর অবশিষ্ট নেই ।

২০০২ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে সখ্য ছিল। তারপর তাঁর কী হলো কে জানে, ২০০৩ সালে বলা নেই কওয়া নেই আমার দ্বিখণ্ডিত বইটি তিনি নিষিদ্ধ করলেন। সেদিনই মনে হয়েছিল আমি তাঁর চেয়ে খাঁটি বামপন্থী। আমি নাস্তিক, আমি নারীবাদী, আমি ধর্ম বর্ণ শ্রেণী লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের সমতা এবং সমানাধিকারে বিশ্বাস করি। একটি মৌলবাদি দেশে কিশোর বয়স থেকে আমার আদর্শের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করছি । আমার দ্বিখণ্ডিত বইটিতে আমি রাষ্ট্রের কোনও রকম ধর্ম থাকার বিরুদ্ধে লিখেছিলাম । রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করার জন্য লিখেছিলাম বলে তিনি আমার বই নিষিদ্ধ করেছিলেন। ভাবা যায়, একজন বড় বামপন্থী নেতা রাষ্ট্রধম ইসলাম থাকা সমর্থন করতে চান। যুক্তি দেন, তা না হলে মুসলমানরা রাগ করবে। হাইকোর্টে কলকাতার মানবাধিকার সংস্থা এপিডিআর দ্বিখণ্ডিত নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা করলো। জয়ী হলো। দ্বিখণ্ডিত থেকে বুদ্ধবাবুর জারি করা নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল। তিনি আমার ওপর আগুন হয়ে রইলেন রেগে। আরে মামলা তো আমি করিনি, জয়ী তো আমি হইনি, সুজাত বাবুরা হয়েছে। এরপর থেকেই আমাকে দেশ থেকে, সম্ভব না হলে কলকাতা থেকে তাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। ২০০৭ সালে আমাকে সাড়ে চারমাস গৃহবন্দি রেখেছিলেন, যেন অতিষ্ট হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাই। কিন্তু কোথাও যাইনি আমি। শেষ পর্যন্ত একটা কুৎসিত নাটক করে তাড়িয়েছিলেন। তারপর কী হলো? আপদ তো বিদায় হলাম। তিনি নিশ্চয়ই খুব আনন্দে ছিলেন তখন। আর অসহায় নিরীহ নির্বাসিত, নির্যাতিত, সৎ ও আপসহীন মানুষটির জীবন কতটুকু দুর্বিষহ হয়েছিল, সে কথা আজ আর নাই বললাম।

ড. ইউনূসের শপথে নেই ভারত! বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সরকার থেকে দূরত্ব?

শুনেছি পরে একটি বই লিখেছেন তিনি। তাঁর কী কী ভুল হয়েছিল তাঁর শাসনামলে, কী কী ভুল তিনি করেছিলেন , সবই লিখেছেন। শুধু আমাকে পশ্চিমবংগ থেকে বিনা দোষে যে তাড়িয়েছিলেন, সেই কথাটা উল্লেখ করেননি। এর মানে এ নিয়ে তাঁর কোনও অনুশোচনা ছিল না, তিনি মনে করতেন তিনি যা করেছিলেন ভাল করেছিলেন। আমার স্বপ্ন সাধ সব চুরমার করে দিয়ে তিনি ভাল করেছিলেন। একজন বাংলা-অন্ত-প্রাণের কাছ থেকে বাংলাকে ছিনিয়ে নিয়ে তিনি ভাল করেছিলেন।

আমি ইউরোপ থেকে বাংলা ভাষার টানে, প্রাণের টানে, কলকাতায় বাস করতে গিয়েছিলাম, যেহেতু বাংলাদেশের কোনও সরকারই আমাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়নি। কিন্তু আমি কল্পনাও করতে পারিনি নন্দনে যে বুদ্ধবাবুর সঙ্গে সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে আড্ডা দিতাম, প্যারিস থেকে তাঁর জন্য তিনি যা চাইতেন উপহার এনে দিলাম, সেই মানুষটি একসময় আমার বাংলা মা’কে, বাংলায় আমার শেষ আশ্রয়টিকে চিরকালের মতো টেনে নিয়ে যাবেন আমার পায়ের তলা থেকে। মমতা দিদি আমার ব্যাপারে বুদ্ধবাবুরই পদাংক অনুসরণ করে চলেন, সুতরাং তিনিও আমাকে একই অচ্ছুৎ হিসেবে ট্রিট করবেন, এতে অবাক হইনা।

দেশে পা রেখেই হিংসা বন্ধের বার্তা ইউনূসের

আজ বুদ্ধবাবুর প্রয়াণে পুরোনো কথা স্মরণ এলো। আমি আত্মায় বিশ্বাস করি না, পরলোকে বিশ্বাস করি না। তাই আজ অন্য সবার মতো বলতে পারলাম না রেস্ট ইন পিস, অথবা যেখানে থাকুন ভাল থাকুন ইত্যাদি। শুধু বলবো, কমরেড, লাল সালাম।”