লক্ষ্য চারু মজুমদারের ‘খতম নীতি’, বাংলাদেশি সাংসদের মত খুন হন কমিউনিস্ট নেতা রূপনারায়ণ রায়

বাংলাদেশের সাংসদ আনোয়ারুল আজীমকে কলকাতায় খুনে জড়িত বাংলাদেশেরই মাওবাদী (Maoist) সংগঠন। তারা ‘ভাড়াটে খুনি’ হিসেবে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ্যে এনেছে। kolkata 24×7 যথাযথ তথ্যের ভিত্তিতে সেই…

বাংলাদেশের সাংসদ আনোয়ারুল আজীমকে কলকাতায় খুনে জড়িত বাংলাদেশেরই মাওবাদী (Maoist) সংগঠন। তারা ‘ভাড়াটে খুনি’ হিসেবে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ্যে এনেছে। kolkata 24×7 যথাযথ তথ্যের ভিত্তিতে সেই সংবাদ প্রকাশ করে বৃহস্পতিবার (২৩ মে)। সংবাদটির শিরোনাম “বাংলাদেশি মাওবাদীদের হানি ট্রাপ শিকার সাংসদ আনোয়ারুল, কলকাতার ফ্ল্যাটেই ছিল লাস্যময়ী”। হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা বাংলাদেশের মাওবাদী সংগঠন “পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি” নামে পরিচিত। তবে দলটি বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত বলেই বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগ জানাচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া তথ্য সাংসদ হত্যায় জড়িতদের কয়েকজন নিষিদ্ধ সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। নকশালপন্থী ভাবধারার দলটি তৈরি হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। এই সংগঠনটির সঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (CPB), বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও অন্যান্য বামপন্থী দল-সংগঠনের কোনও সংযোগ নেই। ‘চরমপন্থী গোষ্ঠী’ হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে মাওবাদী চিন্তাধারার পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (PBCP) গোপনে সক্রিয়। ২০০৯ সাল থেকে তারা একাধিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত।

   

বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাংসদ আনোয়ারুল আজীম আনারকে টুকরো টুকরো করে কেটে দেহাংশ কলকাতা সংলগ্ন নিউটাউন থেকে থেকে পাচার করা হয় বলে পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ একমত। সন্দেহভাজনদের জেরা করে সাংসদ আনোয়ারুলের দেহাংশের খোঁজ চলেছে। নির্দিষ্ট নথি ও রাজনৈতিক ঘটনাক্রম অনুসারে Kolkata 24×7 এবার প্রকাশ করছে সাংসদ হত্যায় ‘ভাড়াটে খুনি’ হিসেবে চর্চিত বাংলাদেশি মাওবাদী গোষ্ঠীর কিছু চমকদার তথ্য।  বাংলাদেশি মাওবাদী গোষ্ঠীর পূর্বসূরীরা জড়িত ছিল উপমহাদেশের অন্যতম কমিউনিস্ট কৃষক নেতা রূপনারায়ণ রায়ের হত্যায়।

তেভাগা সংগ্রামী রূপনারায়ণ ছিলেন পাক সরকারের আতঙ্কের কারণ

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে (১৯৪৬) যুক্ত বাংলার আইনসভার সদস্য ছিলেন ততকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির (CPI) নেতা রূপনারায়ণ রায়। ১৯৪৬ সালে দিনাজপুর থেকে কৃষক নেতা রূপনারায়ণ রায় বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গেই আরও দুজন কমিউনিস্ট জনপ্রতিনিধি জ্যোতি বসু (রেলওয়ে কেন্দ্র) ও রতনলাল ব্রাহ্মণ (দার্জিলিং কেন্দ্র) থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। যুক্ত বাংলা প্রদেশের সরকার গড়েছিল মুসলিম লীগ। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকারের বিরোধী পক্ষে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি ও কংগ্রেস।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়। দিনাজপুর পড়ে যায় পাকিস্তানের পূর্ব অংশে অর্থাত ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। কৃষক নেতা ও জনপ্রতিনিধি রূপনারায়ণ রায় পাক নাগরিকত্ব নেন। তিনি দিনাজপুর থেকে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।  রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে তিনি সরব ছিলেন। তাঁকে জেলে বন্দি করে ছিল পাকিস্তান সরকার। রূপনারায়ণ রায়ের গ্রেফতারের ঘটনায় পূর্ব পাকিস্তান অংশে বিক্ষোভ সংঘটিত হয়। চাপে পড়ে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৩ সালে তাকে মুক্তি দেয় ও ভারতে পাঠানোর উদ্যোগ নেন। অবিভক্ত পাকিস্তানের কমিউনিস্ট নেতা রূপনারায়ণ রায় আত্মগোপনে চলে যান। টানা দেড় দশক তিনি পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান।

১৯৬৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি থেকে সশস্ত্র কৃষক আন্দোলনের ঢেউ ধাক্কা মেরেছিল খুবই নিকটবর্তী ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলে। দিনাজপুরসহ পূর্ব পাকিস্তানেও সেদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে সশস্ত্র ধারার রাজনৈতিক পথ বেছে নেন অনেকে। এই নকশালপন্থীদের বিরোধিতা করেছিলেন রূপনারায়ণ রায়। আর পশ্চিমবঙ্গে চলছিল CPIM ভেঙে তৈরি হওয়া নকশালপন্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। 

নকশালবাড়ি সশস্ত্র কৃষক আন্দোলনের মূল প্রবক্তা চারু মজুমদারের ‘খতম’ পন্থা মেনে পূর্ব পাকিস্তানেও শুরু হয়েছিল প্রতিপক্ষদের খতম অভিযান। একই সময়ে চলছিল বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম। তাতে জড়িয়ে পড়েন রূপনারায়ণ রায়। অভিযোগ, ১৯৭১সালে বাংলাদেশ তৈরির পর নকশালপন্থীদের মূল টার্গেটে ছিলেন জনপ্রিয় কমিউনিস্ট কৃষক নেতা রূপনারায়ণ রায়। সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি নকশালপন্থী খতম নীতি নিয়েছিল।

যেভাবে খুন রূপনারায়ণ রায়
১৯৭৪ সালের ২৪ মার্চ রাতে নিজ বাড়িতেই হত্যার শিকার হন রূপনারায়ণ রায়।  হত্যার দিন সকালে তাঁর পূর্ব পরিচিত কয়েকজন বাড়িতে এসেছিলো। এরা এক সময় রূপনারায়ন রায়ের সাথে একই পার্টি করেছে, পরে চলে যায় নকশালপন্থী ধারায়। রূপনারায়ণের বাড়িতেই ভাত খায় তারা।  আনুমানিক ৮টা নাগাদ গোপণ বিপ্লবীরা মোট ১১ জন একসাথে আক্রমণ চালায় রূপনারায়নের বাড়িতে।  বেয়নেট দিয়ে ঘাড়ে এবং কোমরে প্রচণ্ড আঘাত করে অসুস্থ, বৃদ্ধ রূপনারায়ণ রায়কে।  রূপনারায়ণ রায়কে বাড়ির উঠানে ফেলে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে, তারপর মাও সে তুং আর নকশালবাড়ীর নামে শ্লোগান দিয়ে স্থান ত্যাগ করে। ( সৌ: একতা)

বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ও দেশটির কমিউনিস্ট নেতাদের বেশিরভাগের ধারণা, ব্রিটিশ শাসন ও পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলা রূপনারায়ণ রায়ের খুনের পিছনে যারা জড়িত তারাই পরবর্তী সময় মাওবাদ নীতিতে গোপন সংগঠনগুলি চালাচ্ছে। সাংসদ হত্যায় জড়িত পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি তেমনই একটি মাওবাদী দল। তারা মাও সে তুংয়ের রাজনৈতিক মতবাদকে বিকৃত করছে।