প্রসেনজিৎ চৌধুরী: ভয়াবহ খবরটা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন পেয়েছিলেন তখনই তাঁর প্রাথমিক চটজলদি সিদ্ধান্ত ছিল-শেখ সাহেবের দুই কন্যাকে রক্ষা করো। জার্মানি ও ইংল্যান্ডের ভারতীয় দূতাবাসে নির্দেশ পাঠিয়ে থমথমে মুখে ঘর-বার শুরু করেছিলেন তিনি। সেদিন রক্ষাকারী ইন্দিরা গান্ধী। গুপ্তহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina) গড়লেন এমন এক নজির যা আগে কোনও নারী রাষ্ট্রপ্রধান গড়তে পারেননি। একটানা কুড়ি বছরের মেয়াদে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
খবরটা এসেছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিন।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে শিহরিত হয়েছিল বিশ্ব। ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে সেনা অভ্যুত্থানে জড়িতরা ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করা হয়েছে। থমথমে মুখে সেই সংবাদ শুনে ইন্দিরা গান্ধী সিদ্ধান্ত নেন, বাঁচাতে হবে জার্মানিতে থাকা অরক্ষিত শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাকে।
পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচি অনুসারে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও বিদেশি অতিথিদের সাথে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা বিনিময় ইন্দিরা গান্ধী করেছিলেন নিয়মমাফিক। এর মাঝেই চলছিল হাসিনা-রেহানাকে নিজ হাতের নাগালে রাখার কাজ। ইন্দিরার নির্দেশে সবই হয়েছিল সুচারুভাবে। দিল্লিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেরেছিলেন শেখ হাসিনা ও তাঁর স্বামী ওয়াজেদ মিয়াঁ, শেখ রেহানা।
রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে বাংলাদেশে ফিরে যান ১৯৮১ সালে। ১৯৮৬-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিরোধী নেত্রী। আর ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত প্রথম দফায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী। ২০০১-২০০৮ সাল পর্যন্ত ফের বিরোধী নেত্রী। এরপর বাংলাদেশে শুরু হাসিনা জমানা। ২০০৮ শুরু হয়ে টানা চার দফা ক্ষমতায় থাকা। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর সেই সময়সীমা শেষ হবে ২০২৯ সালে।
একাধিক দেশে তাবড় তাবড় নেত্রীরা ক্ষমতার কেন্দ্রে এসেছেন। বিশ্বে চর্চিত হয়েছেন। তবে কেউই টানা ২০ বছরের মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ তৈরি করতে পারেননি। যেটি করে দেখালেন শেখ হাসিনা।
বি়ভিন্ন সময়ে গত বিংশ শতক থেকে একুশ শতকে নারী রাষ্ট্রপ্রধানদের তালিকা তারকাখচিত- প্রথম নারী রাষ্ট্রপ্রধান সিরিমাভো বন্দরনায়েক (শ্রীলংকা), মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী (ইন্দোনেশিয়া), মার্গারেট থ্যাচার (ইংল্যান্ড), ইন্দিরা গান্ধী (ভারত), বেনজির ভুট্টো (পাকিস্তান), খালেদা জিয়া (বাংলাদেশ), চন্দ্রিকা কুমারতুঙ্গা (শ্রীলংকা), সু কি (মায়ানমার), অ্যাঞ্জেলা মার্কেল (জার্মানি) …আরও কয়েকজন আছেন। এরা একটানা ক্ষমতায় থাকেননি। কেউ না।নজিরবিহীন বিশ্বনজির বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের হিসেব ধরলে এবারের ১২তম জাতীয় নির্বাচনে মোট ভোটারের অর্ধেকও অংশ নেয়নি। তবে এতে পদ্মাপারের ব়াজনীতিতে শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ বিরোধীদের কাছে সমালোচিত। তবে তাঁর ভূমিকা ম্লান হবে না। বিশ্লেষণে উঠে আসছে, দেশটির মূল বিরোধী শক্তি বিএনপি যারা সরকারপক্ষ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমানে টক্কর দিতে পারত। তারা নির্বাচনে অংশ না নিলে সেই দায় সরকারের উপর বর্তায় না।
বিশ্লেষণে উঠে এসেছিল, যদি বিএনপি ভোটে নামত তাহলে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে থাকা দলটি শতাধিক আসনে জয়ী হতে পারত। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বিরোধী হতো তারাই। অনেক আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণে এমনও উঠে এসেছিল, ভোটে নামলে বিএনপি একেবারে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলতেও পারে। তবে ভোট বয়কট করে তারা। বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় বাংলাদেশের ক্ষমতায় শেখ হাসিনা অবলীলায় ফের আসছেন সেটি স্পষ্ট হয়েছিল।
নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২২৪টি জয়ী আওয়ামী লীগ। বিরোধী নির্দলরা পেয়েছে ৬০টি। আর জাতীয় পার্টি পেল ১১টি। অন্যান্যরা ৩টি। ভোট পড়েছে ৪১.৮ শতাংশ। অর্থাত ৫০ শতাংশের কম ভোটে পুনরায় সরকার গড়লেন শেখ হাসিনা। নজিরও গড়লেন তিনি।