প্রসেনজিৎ চৌধুরী: তখন বিশ্ব করোনা ভয়ে কুঁকড়ে ছিল। অদৃশ্য জীবাণু ঘাতকের হামলায় মানব সভ্যতা তথৈবচ। নিস্তেজ সেই সময়ে খরস্রোতা পদ্মা নদীর উপর কিন্তু জেগেছিল অসংখ্য মানুষ। প্রমত্তা পদ্মার তীরে বাংলাদেশে (Bangladesh) ভোর হয়েছিল, বেলা ঢলেছিল, সূর্য অস্ত গেছিল প্রকৃতির নিয়মে। আর দিন রাত করোনা ভয় নিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করেছিলেন নীরবে। একটা দুটো পাল তোলা নৌকো দেখলে শোনা যেত ও মাঝি বইয়া যাও ক্যামনে…।
পদ্মার উপর সেতু বসবে, চাট্টিখানি কথা! এ ভয়ঙ্করী। রাক্ষুসী। সব গিলে নেয়। এমনই পদ্মার সঙ্গে যুদ্ধ মানুষের। কমবেশি পাঁচ হাজার মানুষের দশ হাজার হাতের লড়াই। পদ্মাকে শাসন করা গেল অবশেষে। ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ টানা আট বছর লেগেছে পদ্মা সেতু গড়তে। ২৫ জুন উদ্বোধন। উদ্বোধক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ সেতু ও সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু বিশ্বে অভিনব প্রযুক্তি বিজ্ঞানের উদাহরণ হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশ সেতু বিভাগ জানাচ্ছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল রূপায়ণকারী মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থার সদর কার্যালয় চিনের উহান শহরে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) নথিভুক্ত তথ্য, উহান শহর থেকেই করোনাভাইরাস বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়েছিল। করোনা কবলিত বিশ্ব থমকালেও পদ্মা সেতুর কাজ চলেছিল।
বাংলাদেশ সেতু বিভাগের তথ্য, বিশ্বে সবথেকে খরস্রোতা নদী দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন। দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী পদ্মা। তার উপর সেতু নির্মাণের জন্য যে কঠিন প্রযুক্তি দরকার সেটি প্রয়োগ করা হয়েছে। সেতুটি তৈরি করতে পদ্মা নদীর তলদেশে ঢাল তৈরির জন্য ভারতের ঝাড়খণ্ড থেকে আনা হয় বিপুল পরিমাণ পাথর। একেকটি এক টন ওজনের পাথর ফেলা হয়। বাগে আসে পদ্মা।
অন্ধবিশ্বাসকে কবর দিয়ে যুক্তিবাদের জয়
সেতুটির স্তম্ভ বসানোর কাজ চলাকালীন ২০১৯ সালে রটেছিল গুজব। সেতুর নির্মাণ কাজে মানুষের মাথা প্রয়োজন বলে ফেসবুক সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। অন্ধবিশ্বাসের ঠেলায় বাংলাদেশের জনজীবনের বড় অংশে নেমেছিল আতঙ্ক। গুজব ভয়ানক আকার নেয়। পরিস্থিতি সামলাতে বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ নামে। যুক্তিবাদী বিজ্ঞানকর্মীরা কাজ শুরু করেন। গুজব বন্ধ করা হয়। অন্ধবিশ্বাস হার মানে।
একের পর এক বাধা এসেছে এই সেতু রূপায়ণে। বাংলাদেশ সরকার সব পার করেছে। দুর্নীতির অভিযোগ আসায় বিশ্বব্যাংক আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে। বাংলাদেশ সরকার নিজ অর্থে সেতু তৈরি করিয়েছে। সর্বমোট খরচ ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
প্রমত্তা পদ্মার উপরে সেতু। এর সবথেকে অভিনব দিকটি হলো ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা। ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও দুলবে না পদ্মা সেতু। বিশ্বে এমন সেতু প্রথম।
যে পদ্মা প্রমত্তা। সেই পদ্মায় যন্ত্র ও মানুষের যুগলবন্দি অভিযান মানব ইতিহাসে অভিনব। বিশ্ব সেলাম করছে এই প্রকল্পকে।