কাবুল: ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে (Afghanistan) ফের কাঁপন। মঙ্গলবার পূর্ব আফগানিস্তানে ৫.২ মাত্রার এক ভূমিকম্প আঘাত হানে, যা রবিবার রাতের বিধ্বংসী ৬.০ মাত্রার ভূমিকম্পের মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ঘটল। রবিবার রাতের ভূমিকম্পে কুনার ও নঙ্গরহার প্রদেশে বিপুল প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র কুনার প্রদেশেই মৃতের সংখ্যা ১,৪১১ ছাড়িয়েছে এবং আহতের সংখ্যা ৩,১২৪। নঙ্গরহারে আরও এক ডজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ভূতাত্ত্বিক জরিপ (USGS) জানিয়েছে, মঙ্গলবারের ভূমিকম্পটির কেন্দ্রস্থল ছিল নঙ্গরহার প্রদেশের জালালাবাদ শহর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে এবং ভূ-পৃষ্ঠ থেকে মাত্র আট কিলোমিটার গভীরে। তুলনামূলকভাবে অগভীর ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হয়, বিশেষত আফগানিস্তানের মতো দেশগুলিতে যেখানে অধিকাংশ মানুষ মাটির তৈরি কাঁচা ঘরে বাস করেন।
আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ জানিয়েছেন, কুনার প্রদেশে রবিবারের ভূমিকম্পে অন্তত ৫,৪০০টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। বহু দুর্গম এলাকা এখনও সড়কপথে পৌঁছনো সম্ভব নয়। স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছেন। তাঁরা হাত দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে জীবিতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। গ্রামাঞ্চলে কাদা ও পাথরের বাড়িগুলি মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে পড়েছে।
আফগানিস্তানের পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে আন্তর্জাতিক সাহায্যের অভাব। ২০২১ সালে তালিবান ক্ষমতায় ফেরার পর দেশটিতে বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছে। জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয়কারী ইন্দ্রিকা রাতওয়াটে বলেছেন, “এই দুর্যোগে কয়েক লক্ষ মানুষ প্রভাবিত হতে পারেন। কিন্তু ত্রাণের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।” আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট ফেডারেশন জানিয়েছে, আর্থিক সংকটে মানবিক সেবা সীমিত হয়ে পড়েছে, ফলে দুর্গম এলাকায় পৌঁছনো আরও কঠিন হয়ে উঠছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন আফগানিস্তানের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১৩০ টন জরুরি সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে এবং ১০ লক্ষ ইউরো (প্রায় ১.২ মিলিয়ন ডলার) অর্থ সাহায্য ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যা একসময় আফগানিস্তানের সর্ববৃহৎ দাতা দেশ ছিল, বর্তমানে সাহায্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সাহায্যের ঘাটতি দেশের বিপর্যয় মোকাবিলায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় হাসপাতালগুলিও চরম চাপে পড়েছে। নঙ্গরহার প্রদেশের রাজধানী জালালাবাদের জরুরি বিভাগের প্রধান রাহমতুল্লাহ খাকসার জানিয়েছেন, রবিবার রাতের পর থেকে হাসপাতালে প্রায় ৬০০ আহত রোগী ভর্তি হয়েছেন। অধিকাংশই মাথা, পিঠ, পেট এবং পায়ের আঘাতে গুরুতর জখম। আহতদের অনেকেই পরিবারের খোঁজ পাচ্ছেন না।
গ্রামাঞ্চলে মৃতদের দাফনের দৃশ্য হৃদয়বিদারক। শিশু সহ বহু মানুষকে সাদা কাপড়ে মুড়ে কবর দেওয়া হয়েছে। আফগানিস্তান ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হিসেবে পরিচিত, বিশেষত হিন্দুকুশ পর্বতমালার অঞ্চলে, যেখানে ইউরেশিয়া ও ভারতীয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে ঘন ঘন কম্পন হয়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে পশ্চিম হেরাত প্রদেশে ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে ১,৫০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২২ সালে পাকতিকা প্রদেশে ৫.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রাণ হারিয়েছিলেন এক হাজারের বেশি মানুষ।
আবারও আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের দুর্দশা বিশ্ববাসীর সামনে স্পষ্ট হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া মোকাবিলা করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।