ভারতের চিংড়ি রফতানি খাতে বড় ধরনের ধাক্কার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে (Trump)। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতির কারণে ভারতীয় চিংড়ির উপর মোট আমদানি শুল্ক ৫৮.২৬ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ২০২৫ সালের ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে। ক্রিসিল রেটিংসের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে চলতি অর্থবছরে ভারতের চিংড়ি রপ্তানির পরিমাণ ১৫-১৮ শতাংশ হ্রাস পাবে।
এই পরিস্থিতি ভারতের চিংড়ি চাষী এবং রফতানিকারকদের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশার মতো রাজ্যগুলিতে, যেখানে চিংড়ি চাষ অনেকের জীবিকার প্রধান উৎস।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের চিংড়ি রফতানির জন্য অন্যতম প্রধান বাজার। গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) ভারত থেকে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার মূল্যের চিংড়ি রফতানি হয়েছে, যার মধ্যে ৪৮ শতাংশই গেছে আমেরিকায়। তবে নতুন শুল্ক নীতির ফলে এই বাজারে ভারতের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় চিংড়ির উপর ৫০ শতাংশের পারস্পরিক শুল্কের সঙ্গে ৫.৭৭ শতাংশ কাউন্টারভেলিং শুল্ক এবং ২.৪৯ শতাংশ অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক যুক্ত হয়েছে। এই উচ্চ শুল্কের তুলনায় ইকুয়েডর, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলি অনেক কম শুল্কের (প্রায় ১৫-২০ শতাংশ) সম্মুখীন হচ্ছে, যা ভারতীয় রফতানিকারকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
এই শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব কেবল রফতানির পরিমাণেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি চিংড়ি চাষীদের আয়ের উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বাংলা সহ অন্যান্য রাজ্যে প্রায় ৩,০০,০০০ চিংড়ি চাষী এই খাতের উপর নির্ভরশীল। শুল্ক বৃদ্ধির পর রফতানিকারকরা চাষীদের কাছ থেকে ক্রয়মূল্য প্রায় ২০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে, যা চাষীদের লাভের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে গেছে।
উদাহরণস্বরূপ, গত সপ্তাহে ৪০ কাউন্ট চিংড়ির (প্রতি কিলোগ্রামে ৪০টি চিংড়ি) দাম ১৯ শতাংশ কমে প্রতি কিলোগ্রাম ৩৬৫ টাকায় নেমে এসেছে। এই দাম হ্রাসের ফলে অনেক চাষী ঋণের বোঝায় জর্জরিত হচ্ছেন, এবং কেউ কেউ চিংড়ি চাষ ছেড়ে মাছ চাষের মতো অন্য ব্যবসায় যাওয়ার কথা ভাবছেন।
ক্রিসিল রেটিংসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে রফতানি আয় ১৮-২০ শতাংশ কমে যাবে, যা গত চার বছরে স্থিতিশীল ছিল। উচ্চ শুল্ক, কম ক্ষমতা ব্যবহার এবং মূল্য সংযোজিত ও বড় আকারের চিংড়ির বিক্রি হ্রাসের কারণে এই খাতের অপারেটিং মার্জিন ৫.০-৫.৫ শতাংশে নেমে আসবে, যা গত এক দশকে সর্বনিম্ন।
এই পরিস্থিতিতে রফতানিকারকরা বিকল্প বাজার যেমন যুক্তরাজ্য, চীন এবং রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছেন। ভারত-যুক্তরাজ্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে যুক্তরাজ্যে রপ্তানি তিনগুণ বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, এই বাজারগুলিতে রাতারাতি প্রবেশ করা সম্ভব নয়, এবং উন্নত কোল্ড চেইন পরিকাঠামো ও দ্রুত লজিস্টিকসের প্রয়োজন।
চিংড়ি চাষীদের জন্য এই পরিস্থিতি বিশেষভাবে কঠিন। উৎপাদন খরচ, যেমন জমি ইজারা, বীজ, খাদ্য, এবং জলের গুণমান ব্যবস্থাপনার জন্য বিনিয়োগ, ইতিমধ্যেই বেড়েছে। এর উপর শুল্কের চাপ চাষীদের ব্যবসা অব্যাহত রাখার ইচ্ছাকে দমিয়ে দিচ্ছে।
সীফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট জি. পবন কুমার জানিয়েছেন, মার্কিন ক্রেতারা এই শুল্কের বোঝা বহন করতে রাজি নন, ফলে রফতানিকারকরা দাম কমাতে বাধ্য হচ্ছেন।
ভারত সরকার এই সংকট মোকাবিলায় বাণিজ্য আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক ছাড়ের চেষ্টা করছে। এছাড়া, অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্য সরকারগুলি চাষীদের সহায়তার জন্য ফিডের দাম কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় বাজারে চিংড়ির চাহিদা বাড়ানো এবং রপ্তানির জন্য নতুন বাজার যেমন পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় প্রবেশের উপর জোর দেওয়া উচিত।
এই সংকট ভারতের চিংড়ি শিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তবে বৈচিত্র্যকরণ এবং গুণমান উন্নতির মাধ্যমে এই খাত পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, তাৎক্ষণিকভাবে চাষী এবং রফতানিকারকদের কঠিন সময় পার করতে হবে।