বোলপুর, ২০ অক্টোবর: বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে ‘সহজ পাঠ’ কেবল একটি বই নয়, বরং শৈশবের প্রথম পাঠশালা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই বইয়ের মাধ্যমে অক্ষর চিনতে শিখেছে, ভাষার সৌন্দর্য অনুভব করেছে। কিন্তু বইটির প্রচ্ছদে আঁকা যে তিন পাহাড়ী বটগাছ—তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাস, যা সরাসরি যুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে।
মহর্ষির হাতে বপন, রবীন্দ্রনাথের স্নেহে বড় হওয়া
শান্তিনিকেতন তখনও বিশ্বকবির কর্মযজ্ঞের কেন্দ্রে পরিণত হয়নি। প্রকৃতির কোলে শান্ত পরিবেশে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম যখন আসেন, তখন তিনি এই বটগাছ রোপণ করেছিলেন। এটি ছিল এক ধরণের প্রতীকী পদক্ষেপ—শান্তি, স্থায়িত্ব ও আত্মিক উন্নতির প্রতীক। সময়ের সঙ্গে গাছটি ক্রমে বড় হতে থাকে, ছড়িয়ে পড়ে তার সবল শাখা-প্রশাখা।
পরে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনকে জ্ঞানচর্চার আসন হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করেন, তখন তিনিই গাছটির চারপাশে তিনটি নুরির ধাপ দিয়ে এক বিশেষ রূপ দেন। সেই থেকেই এর নাম হয় ‘তিন পাহাড়ী বটগাছ’। এই গাছের তলায় বসেই কবিগুরু লিখেছেন তাঁর বহু অমূল্য কবিতা, যা বাঙালির সাহিত্যভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ।
সহজ পাঠের প্রচ্ছদে কেন এই গাছ?
শিশুদের প্রথম পাঠ্যগ্রন্থ ‘সহজ পাঠ’-এর প্রচ্ছদে এই গাছের ছবি ব্যবহারের পেছনে রয়েছে গভীর প্রতীকী তাৎপর্য। এটি শুধু একটি প্রকৃতির ছবি নয়, বরং জ্ঞানের আশ্রয়, সৃজনশীলতার উন্মেষ এবং সংস্কৃতির শিকড়ের প্রতিচ্ছবি। একদিকে রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রেরণা, অন্যদিকে শান্তিনিকেতনের আত্মা—এই গাছ যেন দুইয়ের সেতুবন্ধন।
স্থানীয়দের চোখে ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী
শান্তিনিকেতনের মানুষ আজও এই গাছকে সম্মান করে। বহু প্রবীণ স্থানীয়ের মতে, এই গাছের নিচে বসেই রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের সঙ্গে আলাপচারিতা করতেন, কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং জীবনদর্শনের পাঠ দিতেন। আজও হাজার হাজার পর্যটক, গবেষক এবং সাহিত্যপ্রেমী আসেন এই বটগাছ দেখতে। তাঁদের চোখে এটি কেবল একটি গাছ নয়, বরং ইতিহাসের জীবন্ত দলিল।
আজকের প্রাসঙ্গিকতা
যখন আমরা আধুনিকতার ভিড়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি, তখন এই গাছ আমাদের মনে করিয়ে দেয় শিকড়ের গুরুত্ব। শিশুদের প্রথম পাঠ্যবইয়ে এই গাছের ছবি থাকাটাই প্রমাণ করে—আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য প্রকৃতির সঙ্গে কত গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।
‘তিন পাহাড়ী বটগাছ’ তাই শুধু শান্তিনিকেতনের নয়, গোটা বাঙালির ঐতিহ্যের অংশ। মহর্ষির হাতে বপন ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহে বড় হওয়া এই গাছ আজও দাঁড়িয়ে আছে জ্ঞানের, সৃজনশীলতার ও আত্মিকতার প্রতীক হয়ে। সহজ পাঠের প্রচ্ছদে আঁকা এই চিরন্তন প্রতীক আমাদের শৈশবের স্মৃতি যেমন জাগিয়ে তোলে, তেমনই বাংলা সাহিত্যের শিকড়ের সঙ্গে আমাদের সংযুক্ত করে রাখে।