বর্ধমান–দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে পরাজয়ের পর বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ (Dilip Ghosh) আবারও স্পষ্ট জানালেন, তিনি নিজের ইচ্ছায় ভোটে লড়তে চাননি। খড়গপুরে দলের নতুন জেলা কার্যালয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে তিনি জানান, দলের সিদ্ধান্তে তিনি ওই কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন, ব্যক্তিগতভাবে সেখানে লড়াই করতে তাঁর অনিচ্ছা ছিল। এই মন্তব্যকে ঘিরে রাজনৈতিক মহলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
দিলীপ ঘোষের বক্তব্য, “দল নির্দেশ দিয়েছিল, তাই লড়েছি। ওই কেন্দ্র আমার চেনা ছিল না। আমি নিজে থেকে বর্ধমান–দুর্গাপুরে প্রার্থী হতে চাইনি। দল বললে আবার লড়ব, না বললে শুধু কর্মী হিসেবেই কাজ করে যাব।” তাঁর এই মন্তব্যের পর অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—এ কি নির্বাচনী ফলাফলের দায় এড়ানোর প্রচেষ্টা, নাকি দলের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিনের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ?
২০১৯ সালে মেদিনীপুর আসনে প্রায় ৮৯ হাজার ভোটে জিতে রাজ্য রাজনীতিতে নিজের অবস্থান মজবুত করেছিলেন দিলীপ ঘোষ। কিন্তু ২০২4 সালে বর্ধমান–দুর্গাপুরে তৃণমূলের কীর্তি আজাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে তিনি প্রায় ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ভোটে পরাজিত হন। ভোট-পরবর্তী সময়ে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন “চক্রান্ত” এবং “অভ্যন্তরীণ খেলায়” তাঁর পরাজয় হয়েছে। যদিও এই অভিযোগের বিস্তারিত তিনি কখনও প্রকাশ্যে আনেননি।
এ দিনও দিলীপ বলেন, “কী হয়েছে, কে করেছে সবই পর্যালোচনার বিষয়। দলের রাজ্য নেতৃত্ব ও কেন্দ্র নেতৃত্ব বসে আলোচনা করবে। আমি এখন কিছু বলতে চাই না।” রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তাঁর বক্তব্য পরিষ্কার—পরাজয়ের দায় তিনি নিজের ওপর সম্পূর্ণ নিতে রাজি নন।
এর আগের দিনই দিলীপ ঘোষ এক্স-এ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর একটি বক্তৃতা পোস্ট করেন। উদ্ধৃতিতে লেখা ছিল, “দলের পুরনো এক জন কর্মীকেও ভাঙতে দিও না। নতুনরা ১০ জন চলে গেলে ক্ষতি নেই। পুরনো কর্মীরাই বিজয়ের গ্যারান্টি।” দিলীপ সেই পোস্টকে “সময়োপযোগী” মন্তব্য করে নিজের পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে ধরেছেন বলে মনে করছেন অনেকেই।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, তাঁর এই ইঙ্গিত স্পষ্ট করে যে বিজেপির অভ্যন্তরে নতুন মুখদের গুরুত্ব বাড়ায় পুরনো নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ জমেছে। বিশেষ করে গত দুই বছরে রাজ্য নেতৃত্বে পরিবর্তনের পর দিলীপ ঘোষকে সংগঠনের প্রধান অবস্থান থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর থেকেই দলীয় অভ্যন্তরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের খবর সামনে এসেছে।
এ নিয়ে তৃণমূল মুখপাত্রদের দাবি, বিজেপির মধ্যে “তীব্র বিভাজন” এবং “দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামো” আবারও সামনে এসেছে। তাঁদের কথায়, “যে দল নিজেদের ঘর সামলাতে পারে না, তারা বাংলায় ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখে কীভাবে?”
অন্যদিকে বিজেপির একাংশ জানাচ্ছে, দিলীপ ঘোষের কথায় অতিরঞ্জন নেই। তারা স্বীকার করছে যে বর্ধমান–দুর্গাপুর কেন্দ্রে দিলীপ ঘোষের সংগঠনগত ততটা প্রভাব ছিল না। এক নেতা বলেন, “দিলীপদা মেদিনীপুরে শক্তিশালী ছিলেন। হঠাৎ তাঁকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়ায় সমস্যা তৈরি হয়। তবে দলের সিদ্ধান্ত মেনে তিনি লড়েছেন, এটা বড় বিষয়।”
তবে দিলীপ ঘোষের বক্তব্যে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েও সূক্ষ্ম প্রশ্ন উঠছে। রাজনৈতিক মহলে মত—দিলীপ ঘোষের অবস্থান স্পষ্টতই প্রতিরোধমূলক। তিনি দলের সিদ্ধান্তে আপত্তি তুলছেন না, কিন্তু নিজের ভূমিকাকে নিরপেক্ষভাবে ব্যাখ্যা করছেন। এতে দলীয় অভ্যন্তরের চাপ তৈরি হতে পারে।
বিজেপির অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্র নেতৃত্ব রাজ্য সংগঠনের কাঠামো আরও শক্তিশালী করতে চাইছে। সেই প্রক্রিয়ায় দিলীপ ঘোষকে ময়দানে সক্রিয় রাখতে চেষ্টা চলছে। দিলীপও বলেন, “দল বললে আবার লড়ব। আমি কর্মী হিসেবে কাজ করে যাব।”
রাজনৈতিক মহলের মতে, দিলীপ ঘোষ এখনও বিজেপির অন্যতম জনপ্রিয় মুখ। জনসংযোগে তাঁর দক্ষতা এবং সরাসরি কথাবলার অভ্যাস তাঁকে বিজেপির কর্মীসমাজে জনপ্রিয় করেছে। তবে কঠিন পরাজয়ের পর তাঁর ক্ষোভ এবং হতাশা দলের পক্ষে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
তৃণমূল শিবির দাবি করছে, “পরাজয়ের কারণ নিজেরাই জানেন। বিজেপি তাদের ব্যর্থতার দায় নিজেদের ওপর না নিয়ে অন্যের ওপর চাপাতে চাইছে।”
সব মিলিয়ে, দিলীপ ঘোষের মন্তব্য রাজ্য রাজনীতিতে নতুন করে উত্তাপ ছড়িয়েছে। ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনের আগে তাঁর ভূমিকা কী হবে, তা এখন বড় প্রশ্ন।
