পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা তথা নন্দীগ্রামের (nandigram) বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী সোমবার, ৩১ মার্চ ২০২৫, একটি বড় ঘোষণা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, অযোধ্যার রাম মন্দিরের আদলে নন্দীগ্রামে একটি রাম মন্দির নির্মিত হবে। এই মন্দিরটি তাঁর নিজের নামে থাকা ৪ বিঘা (১.৫ একর) জমির ওপর নির্মাণ করা হবে। শুভেন্দু জানান, আগামী ৬ এপ্রিল, রাম নবমীর দিন সকাল ১০টায় এই মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে। এই ঘোষণার পর থেকেই রাজনৈতিক মহলে বিতর্কের ঝড় উঠেছে।
তৃণমূল কংগ্রেস (TMC) অভিযোগ তুলেছে
তৃণমূল কংগ্রেস (TMC) অভিযোগ তুলেছে যে, শুভেন্দু অধিকারী যখন তৃণমূলের সাংসদ ছিলেন, তখন তিনি এমপিএলএডি (সাংসদ স্থানীয় এলাকা উন্নয়ন তহবিল) থেকে খুব কম দামে এই জমি কিনেছিলেন। তৃণমূলের দাবি, এই জমি নন্দীগ্রামের শহীদ পরিবারগুলির জন্য একটি হাসপাতাল নির্মাণের উদ্দেশ্যে কেনা হয়েছিল।
তৃণমূলের এক নেতা বলেন, “শুভেন্দু যদি মন্দির বানাতে চান, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি যে উদ্দেশ্যে জমি কিনেছিলেন, সেই শহীদ পরিবারগুলির জন্য একটি হাসপাতালও বানানো উচিত।” অন্যদিকে, বিজেপি এই অভিযোগকে ‘বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের দাবি, জমি কেনার বিষয়ে কোনো অনিয়ম হয়নি, এবং তৃণমূল কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই ইস্যুকে উসকে দিচ্ছে।
আরো দেখুন বিস্ফোরক স্যাম অল্টম্যান! ‘টুইটার নেগেটিভ, কিন্তু Ghibli ট্রেন্ডে আনন্দ’
রাজনৈতিক প্রভাব আরও জোরদার করার চেষ্টা
শুভেন্দু অধিকারী এই ঘোষণার মাধ্যমে নন্দীগ্রামে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব আরও জোরদার করার চেষ্টা করছেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তিনি বলেছেন, “এই মন্দির অযোধ্যার রাম মন্দিরের প্রতিরূপ হবে। আমি নন্দীগ্রামের মানুষকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, রাম নবমীর দিন সকালে হাজার হাজার মহিলা শঙ্খ বাজিয়ে এই অনুষ্ঠানে যোগ দিন।” তিনি আরও জানান, মন্দিরের পাশাপাশি আয়ুর্বেদিক ও অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসাকেন্দ্রও নির্মিত হবে। তবে তৃণমূলের অভিযোগ, এমপিএলএডি তহবিলের টাকায় কেনা জমিতে শুধুমাত্র ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণ শহীদ পরিবারগুলির সঙ্গে প্রতারণার শামিল।
নন্দীগ্রামে (nandigram) রাম মন্দির নতুন কিছু নয়। এখানে ইতিমধ্যেই একটি প্রাচীন রাম মন্দির রয়েছে, যা ১৮০৩ সালে নির্মিত হয়েছিল। এটি জানকীনাথ মন্দির নামে পরিচিত এবং এটিকে বাংলার প্রাচীনতম রাম মন্দিরগুলির মধ্যে একটি বলে মনে করা হয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এই মন্দিরের রামের মূর্তির হাতে ধনুক-তির নেই, যা অন্যান্য রাম মন্দির থেকে এটিকে আলাদা করে। শুভেন্দু অধিকারী এই মন্দিরের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রায়ই এই মন্দিরে যান এবং এর উন্নয়নে অবদান রেখেছেন।
রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক
এই নতুন মন্দির নির্মাণের ঘোষণা রাজ্যের রাজনীতিতে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিম বলেন, “নন্দীগ্রামে ধর্মীয় উৎসব শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়। শুভেন্দু যদি মন্দির বানাতে চান, তিনি বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে জমি কিনেছিলেন, তা পূরণ করা উচিত।” তিনি আরও বলেন, “বাংলার মানুষ রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দের আদর্শে বিশ্বাসী। শুভেন্দুর এই ধরনের ঘোষণা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে না।” অন্যদিকে, বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বলেন, “এটি শুভেন্দুর ব্যক্তিগত জমি। তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। তৃণমূল এখানে অযথা বিতর্ক তৈরি করছে।”
রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছে, এই ঘোষণার পিছনে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে হিন্দু ভোটকে একত্রিত করার কৌশল রয়েছে। শুভেন্দু ইতিমধ্যেই দাবি করেছেন যে, আগামী রাম নবমীতে পশ্চিমবঙ্গে ২০০০টি শোভাযাত্রায় ১ কোটি হিন্দু অংশ নেবে। তিনি বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণভাবে রাম নবমী পালন করব। এর জন্য কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই।” তবে, সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, “রাম নবমী বাংলায় কখনও গণউৎসব ছিল না। এটি বিজেপি এবং তৃণমূলের রাজনৈতিক হাতিয়ার মাত্র।”
নন্দীগ্রামের (nandigram) ইতিহাসে ধর্মীয় স্থাপনা
নন্দীগ্রামের ইতিহাসে ধর্মীয় স্থাপনা এবং রাজনীতি একসঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। ২০০৭ সালের ভূমি আন্দোলনের পর থেকে এই এলাকা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে শুভেন্দু এখান থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করেছিলেন। এই মন্দির নির্মাণের ঘোষণা তাঁর নির্বাচনী এলাকায় প্রভাব ধরে রাখার একটি কৌশল বলে মনে করা হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিক্রিয়া
স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ বলেন, “মন্দির হলে ভালো, কিন্তু আমাদের হাসপাতালও দরকার। শুভেন্দুবাবু এখানকার ছেলে, তিনি আমাদের কথা ভাববেন।” অন্যরা বলেন, “এটা রাজনীতির খেলা। আমরা চাই উন্নয়ন, শুধু মন্দির নয়।”
এই ঘটনা নিয়ে পুলিশও সতর্ক রয়েছে। রাম নবমীর শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে অতীতে নন্দীগ্রামে উত্তেজনা দেখা গেছে। পুলিশ জানিয়েছে, তারা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে এবং শান্তি বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
শুভেন্দু অধিকারীর এই পরিকল্পনা নন্দীগ্রামের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক চিত্রকে নতুন মোড় দিতে পারে। তবে এটি শহীদ পরিবারগুলির প্রতি তাঁর পূর্বের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। রাম নবমীতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর এই বিতর্ক কোন দিকে যায়, তা দেখার বিষয়।