বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকাংশই মহিলা, প্রকাশ্যে চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট

পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) থেকে অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধানে পাড়ি দেওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের (Migrant Workers) মধ্যে অধিকাংশই মহিলা, এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে।…

Shocking Report: Majority of West Bengal’s Migrant Workers Are Women, Facing Exploitation

পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) থেকে অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধানে পাড়ি দেওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের (Migrant Workers) মধ্যে অধিকাংশই মহিলা, এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যার দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ দেশে সপ্তম স্থানে রয়েছে, এবং এই শ্রমিকদের মধ্যে মহিলাদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এই তথ্য সমাজের বিভিন্ন স্তরে আলোচনার সৃষ্টি করেছে এবং রাজ্যের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর উপর নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনেছে।

পরিযায়ী শ্রমিকদের তথ্য ও প্রেক্ষাপট
২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় ৩৩.৪৪ লক্ষ মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজের জন্য স্থানান্তরিত হয়েছেন। এই বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে মহিলারা একটি বড় অংশ দখল করে আছেন। বিশেষ করে গৃহকর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক এবং ক্ষুদ্র শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের মধ্যে মহিলাদের প্রাধান্য লক্ষণীয়। এই মহিলারা প্রধানত দিল্লি, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, হরিয়ানা এবং কর্ণাটকের মতো রাজ্যে কাজের জন্য যাচ্ছেন।

   

মহিলা শ্রমিকদের প্রাধান্যের কারণ
মহিলাদের মধ্যে পরিযায়নের প্রবণতা বৃদ্ধির পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। গ্রামীণ অঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়া, কৃষি ক্ষেত্রে আয়ের অভাব, এবং পারিবারিক দারিদ্র্য মহিলাদের বাধ্য করছে অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধানে যেতে। এছাড়াও, শহরাঞ্চলে গৃহকর্মী এবং নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে মহিলাদের চাহিদা বেশি থাকায়, তাঁরা এই ক্ষেত্রে যোগ দিচ্ছেন। তবে, এই পরিযায়নের পিছনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অনেক ক্ষেত্রে, পুরুষরা পরিবারের প্রধান আয়ের উৎস হলেও, মহিলারা পরিবারের অতিরিক্ত আয়ের জন্য পরিযায়ী হচ্ছেন।

চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা
পরিযায়ী মহিলা শ্রমিকদের জীবন সংগ্রামে ভরপুর। তাঁরা প্রায়শই নিম্ন মজুরি, অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ, এবং শোষণের শিকার হন। অনেক মহিলা শ্রমিক জানিয়েছেন, তাঁরা কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, যৌন হয়রানি, এবং নিরাপত্তার অভাবের মতো সমস্যার সম্মুখীন হন। এছাড়াও, তাঁদের পরিবার থেকে দূরে থাকার কারণে মানসিক চাপ এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতাও তাঁদের জীবনকে জটিল করে তোলে। শিশুদের লালন-পালন এবং শিক্ষার দায়িত্বও অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের উপর বর্তায়, যা তাঁদের জন্য অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ
পরিযায়ী শ্রমিকদের, বিশেষ করে মহিলাদের, সুরক্ষা ও কল্যাণের জন্য সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ই-শ্রম’ পোর্টালের মাধ্যমে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিবন্ধন করা হচ্ছে, যাতে তাঁরা সামাজিক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুবিধা পেতে পারেন। তবে, এই প্রকল্পের সুফল এখনও অনেক মহিলা শ্রমিকের কাছে পৌঁছায়নি। এছাড়াও, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা মহিলা শ্রমিকদের জন্য প্রশিক্ষণ, আইনি সহায়তা এবং নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছে। তবে, এই উদ্যোগগুলোর পরিধি এখনও সীমিত, এবং বৃহত্তর সচেতনতা ও সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে।

Advertisements

সমাজ ও অর্থনীতির উপর প্রভাব
মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকদের এই প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ ও শহুরে অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। একদিকে, তাঁদের আয় পরিবারের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে, গ্রামীণ এলাকায় শ্রমশক্তির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। এছাড়াও, মহিলাদের এই পরিযায়ন তাঁদের সামাজিক ক্ষমতায়নের দিকে ইঙ্গিত করলেও, তাঁদের নিরাপত্তা ও অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য আরও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।

ভবিষ্যৎ পথ
এই রিপোর্টটি সরকার, নীতিনির্ধারক এবং সমাজের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে। মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, ন্যায্য মজুরি, এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি, গ্রামীণ অঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে পরিযায়নের উপর নির্ভরতা কমানো যেতে পারে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং সামাজিক সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে মহিলাদের প্রাধান্য একদিকে তাঁদের সাহস ও সংগ্রামের গল্প বলে, অন্যদিকে সমাজের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে। এই মহিলারা শুধু নিজেদের পরিবারের জন্যই নয়, দেশের অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তাঁদের অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষিত করার জন্য সমাজের সব স্তরে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এই রিপোর্ট আমাদের সকলকে এই দিকে আরও সচেতন ও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।