পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মহম্মদবাজার ব্লকের দেউচা পাঁচামি কয়লা খনি প্রকল্পকে ঘিরে নতুন করে বিতর্কের ঝড় উঠেছে (Salim)। সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এই প্রকল্পের নামে বিরাট দুর্নীতির অভিযোগ তুলে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন।
সেলিমের দাবি, দেউচা পাঁচামি কয়লা খনি প্রকল্প কোনও শিল্পোন্নয়নের উদ্যোগ নয়, বরং তৃণমূলের দুর্নীতির একটি বড় ফাঁদ। তিনি এই প্রকল্পে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব এবং শেল কোম্পানির মাধ্যমে বিপুল অর্থ লেনদেনের অভিযোগ তুলেছেন, যা রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।মহম্মদ সেলিম সিউড়ি ও বোলপুরে সিপিআই(এম)-এর মিছিলে অংশ নিয়ে এই অভিযোগ তুলেছেন।
তিনি বলেন, “সারদা, নারদা, চাকরি, বালি, মাটি, জল, জমি—রাজ্য জুড়ে তৃণমূলের দুর্নীতির ফিরিস্তি শেষ হয় না। এবার দেউচা পাঁচামি কয়লা খনির নামে আরেকটি বিরাট জালিয়াতি চলছে।” সেলিমের অভিযোগ, যে কোম্পানিকে পাথর ও ব্যাসল্ট অপসারণের জন্য টেন্ডার দেওয়া হয়েছিল, তারা ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (WPDCL)-এর শর্ত ভঙ্গ করে কাজ শুরুর আগেই মালিকানা হস্তান্তর করেছে।
টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী মালিকানা বদল নিষিদ্ধ ছিল। এছাড়া, তিনি দাবি করেছেন যে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত একটি শেল কোম্পানি গত বছর কোনও কাজ না করা একটি কোম্পানিকে ১৫০ কোটি টাকা প্রদান করেছে। এই অভিযোগগুলি তিনি সিউড়িতে সিপিআই(এম)-এর একটি মিছিলে প্রকাশ করেছেন, যেখানে পলিটব্যুরো সদস্য রামচন্দ্র ডোমও উপস্থিত ছিলেন।
দেউচা পাঁচামি কয়লা খনি ভারতের বৃহত্তম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা খনি হিসেবে পরিচিত। এই প্রকল্পে প্রায় ২১০২ মিলিয়ন টন কয়লা মজুত রয়েছে এবং এটি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মহম্মদবাজার ব্লকে অবস্থিত।
২০১৬ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন, দাবি করে যে এটি রাজ্যে লক্ষাধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং আগামী ১০০ বছরের জন্য রাজ্যের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাবে। তিনি জানিয়েছিলেন, প্রকল্পে ২০,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হবে, যার মধ্যে ১০,০০০ কোটি টাকা জমিদাতা ও আদিবাসীদের পুনর্বাসনের জন্য ব্যয় হবে।
কিন্তু এই প্রকল্প নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক চলছে। স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায় জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করেছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০২১ সালে ঘোষণা করেছিলেন যে, জমিদাতাদের সম্মতি ছাড়া জমি অধিগ্রহণ করা হবে না এবং প্রতিটি জমিদাতা পরিবার থেকে একজনকে চাকরি দেওয়া হবে। এর ফলে অনেকে জমি দিতে রাজি হয়েছেন, এবং ইতিমধ্যে ২৬০ জন জমিদাতাকে জুনিয়র কনস্টেবল পদে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে। তবে, সেলিমের সাম্প্রতিক অভিযোগ এই প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে।
সেলিমের দাবি, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম হয়েছে। তিনি বলেন, “যে কোম্পানিকে ব্যাসল্ট অপসারণের কাজ দেওয়া হয়েছিল, তারা শর্ত ভঙ্গ করে মালিকানা হস্তান্তর করেছে। এমনকি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত একটি শেল কোম্পানি ১৫০ কোটি টাকা এমন একটি কোম্পানিকে দিয়েছে, যার গত বছর কোনও কাজ ছিল না। এটা স্পষ্ট দুর্নীতি।”
তিনি এই ঘটনার তদন্তের দাবি জানিয়েছেন এবং আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সামাজিক মাধ্যমে এই অভিযোগ ছড়িয়ে পড়েছে, এবং সিপিআই(এম) সমর্থকরা দাবি করছেন যে এই প্রকল্পের নামে আদিবাসীদের জমি লুট করা হচ্ছে এবং জাতীয় সম্পদের অপব্যবহার হচ্ছে।তৃণমূল কংগ্রেস এই অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
দলের এক মুখপাত্র বলেন, “মহম্মদ সেলিম মিথ্যা অভিযোগ তুলে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছেন। দেউচা পাঁচামি প্রকল্প রাজ্যের উন্নয়নের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে জমিদাতাদের পুনর্বাসন ও চাকরির প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছেন।” তৃণমূলের দাবি, এই প্রকল্পে কোনও অনিয়ম হয়নি এবং সবকিছু স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই অভিযোগ তৃণমূলের জন্য নতুন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। বিশ্লেষক সুজিত ঘোষ বলেন, “দেউচা পাঁচামি প্রকল্প নিয়ে আগে থেকেই বিতর্ক ছিল। সেলিমের অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে এটি তৃণমূলের ভাবমূর্তির উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।”
বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে নিয়মিত বাংলায় আসবেন অমিত শাহ
তবে, তিনি এও বলেন, “এই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণের জন্য কঠিন তথ্যপ্রমাণ প্রয়োজন।”সামাজিক মাধ্যমে এই ইস্যু নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “দেউচা পাঁচামি প্রকল্পের নামে যদি সত্যিই দুর্নীতি হয়ে থাকে, তাহলে এটি বাংলার মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।”
আরেকজন লিখেছেন, “তৃণমূলের উন্নয়নের নামে এটি আরেকটি জালিয়াতি।”এই ঘটনা আগামী দিনে রাজ্যের রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে সবার নজর রয়েছে। মহম্মদ সেলিমের অভিযোগের পর তদন্তের দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে, এবং এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চয়তার মুখে।