কোচবিহার রাজবাড়ির সুড়ঙ্গ কোচ রাজবংশের গোপন পথের রহস্য!

কোচবিহার রাজবাড়ি (Cooch Behar Palace) পশ্চিমবঙ্গের একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ, শুধুমাত্র তার স্থাপত্যশৈলী বা রাজকীয় গৌরবের জন্যই নয়, বরং এর গোপন সুড়ঙ্গের রহস্যময় গল্পের জন্যও বিখ্যাত।…

Unraveling the Mystery of Cooch Behar Palace Secret Tunnel

কোচবিহার রাজবাড়ি (Cooch Behar Palace) পশ্চিমবঙ্গের একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ, শুধুমাত্র তার স্থাপত্যশৈলী বা রাজকীয় গৌরবের জন্যই নয়, বরং এর গোপন সুড়ঙ্গের রহস্যময় গল্পের জন্যও বিখ্যাত। এই রাজবাড়ি, যা ১৮৮৭ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের শাসনামলে ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্যালেসের আদলে নির্মিত হয়েছিল, কোচ রাজবংশের শাসনকালের এক গৌরবময় অধ্যায়ের সাক্ষী। তবে, এই রাজবাড়ির গোপন সুড়ঙ্গ নিয়ে জনমানসে বহু গল্প ও কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। এই সুড়ঙ্গ কোথায় শেষ হয় এবং এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য কী, তা নিয়ে আজও রহস্যের আবরণ রয়ে গেছে।

কোচবিহার রাজবাড়ির গোপন সুড়ঙ্গ নিয়ে স্থানীয় লোককথা ও ঐতিহাসিক গবেষণায় বহু তথ্য পাওয়া যায়। কথিত আছে, এই সুড়ঙ্গ রাজবাড়ি থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পৌঁছাতো, যেমন মদনমোহন মন্দির বা এমনকি কোচবিহারের বাইরে অন্য কোনো গোপন আশ্রয়স্থল। এই সুড়ঙ্গগুলি মূলত রাজপরিবারের সুরক্ষার জন্য নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। শত্রুদের আক্রমণ বা বিপদের সময় রাজা-রানি এবং তাঁদের পরিবার এই গোপন পথ ব্যবহার করে নিরাপদে পালিয়ে যেতেন। কিন্তু এই সুড়ঙ্গের শেষ স্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য ইতিহাসে পাওয়া যায় না। কেউ কেউ বলেন, এটি মদনমোহন মন্দিরের কাছে শেষ হয়েছে, আবার কেউ বলেন, এটি শহরের বাইরে কোনো গোপন স্থানে গিয়ে মিশেছে।

   

কোচবিহারের ইতিহাসে এই সুড়ঙ্গের গুরুত্ব অপরিসীম। কোচ রাজবংশ, যারা প্রায় ৫০০ বছর ধরে এই অঞ্চল শাসন করেছিল, তাদের সময়ে এই সুড়ঙ্গগুলি কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৬শ শতাব্দীতে বিশ্ব সিংহ এবং তাঁর পুত্র নরনারায়ণের শাসনকালে কোচবিহার রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটে। এই সময়ে মুঘল, ভুটান এবং অন্যান্য প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ ও আক্রমণের আশঙ্কা ছিল সর্বদা। ফলে, এই গোপন পথগুলি রাজপরিবারের জন্য একটি নিরাপত্তা কবচ হিসেবে কাজ করত। কিংবদন্তি অনুসারে, এই সুড়ঙ্গ দিয়ে রাজপরিবার শুধু পালিয়ে যেতেন না, বরং গোপনে গুপ্তচর বা সৈন্যদের মাধ্যমে শত্রুদের উপর নজর রাখতেন।

বর্তমানে কোচবিহার রাজবাড়ি একটি জাদুঘর হিসেবে পরিচালিত হয় এবং এটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। রাজবাড়ির অভ্যন্তরে রাজপরিবারের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, অস্ত্র, গয়না এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। তবে, সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ বা এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সাধারণ দর্শকদের জন্য কোনো প্রকাশ্য তথ্য নেই। পুরাতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদদের মতে, এই সুড়ঙ্গগুলি সম্ভবত ভূমিকম্প বা সময়ের প্রভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে বা ভরাট হয়ে গেছে। তবুও, স্থানীয়দের মধ্যে এই গোপন পথ নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই।

Advertisements

কিছু গবেষক মনে করেন, এই সুড়ঙ্গগুলি কোচবিহারের অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থান, যেমন ভেটাগুড়ির প্রাচীন রাজপ্রাসাদ বা অন্য কোনো দুর্গের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। ভেটাগুড়িতে প্রথম কোচবিহার রাজপ্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল, যা বর্তমান রাজবাড়ির তুলনায় অনেক পুরনো। কেউ কেউ এমনও দাবি করেন যে এই সুড়ঙ্গ দিয়ে রাজপরিবার তিস্তা নদীর তীরে কোনো গোপন স্থানে পৌঁছাতে পারতেন। তবে, এই দাবিগুলির কোনো প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায়নি।

কোচবিহার রাজবাড়ির গোপন সুড়ঙ্গ নিয়ে আধুনিক গবেষণা এখনও অগ্রগতির পথে। জেলা প্রশাসন এবং পুরাতত্ত্ব বিভাগ সম্প্রতি রাজবাড়ির ইতিহাসকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো-এর মাধ্যমে এর গল্প তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রকল্পে সুড়ঙ্গের রহস্য নিয়েও আলোকপাত করা হতে পারে, যা পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণ বাড়াবে।

শেষ পর্যন্ত, কোচবিহার রাজবাড়ির গোপন সুড়ঙ্গের শেষ স্থান এখনও একটি রহস্যই রয়ে গেছে। এটি কি মদনমোহন মন্দিরে শেষ হয়, নাকি তিস্তা নদীর তীরে কোনো গোপন আশ্রয়ে? নাকি এটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের আরও গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন। তবে, এই রহস্যই কোচবিহার রাজবাড়িকে পর্যটকদের কাছে আরও রোমাঞ্চকর করে তুলেছে।