অনুন্নয়নের করুণ চিত্র! ফাঁসিদেওয়া গ্রামীণ হাসপাতালে ‘দুয়ারে পচা জল’

সৌরভ রায়, শিলিগুড়ি: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ‘দুয়ারে সরকার’ ক্যাম্পেইন একসময় রাজ্যের মানুষের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। কিন্তু এখন শিলিগুড়ির ফাঁসিদেওয়া গ্রামীণ হাসপাতালের (Phansidewa Rural…

Stagnant Water at Siliguri’s Phansidewa Rural Hospital Entrance Sparks Public Outrage

সৌরভ রায়, শিলিগুড়ি: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ‘দুয়ারে সরকার’ ক্যাম্পেইন একসময় রাজ্যের মানুষের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। কিন্তু এখন শিলিগুড়ির ফাঁসিদেওয়া গ্রামীণ হাসপাতালের (Phansidewa Rural Hospital) প্রবেশপথে জমে থাকা পচা জল যেন এই উদ্যোগের বিপরীত একটি ছবি তুলে ধরছে। সামান্য বৃষ্টিতেই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রবেশপথ জলমগ্ন হয়ে পড়ছে, যার ফলে রোগী ও তাঁদের পরিবারকে নোংরা জলের মধ্য দিয়ে হেঁটে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এই ঘটনা রাজ্যের স্বাস্থ্য অবকাঠামোর অনুন্নয়নের একটি করুণ চিত্র উন্মোচন করেছে।

দার্জিলিং জেলার ফাঁসিদেওয়া গ্রামীণ হাসপাতালটি কয়েক লক্ষ মানুষের ভরসার ঠিকানা। বিশেষ করে চা বাগানের আদিবাসী সম্প্রদায় এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্য এটি জীবন রক্ষার একমাত্র কেন্দ্র। কিন্তু হাসপাতালের প্রবেশপথে জমে থাকা পচা জল এবং নিকাশি ব্যবস্থার অভাব এলাকাবাসীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। মুমূর্ষু রোগীরা জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসে নোংরা জলে পা ডুবিয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করছেন। মহিলারা হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে এই জলের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। এই দৃশ্য যেন রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।

   

সমস্যার মূল: নিকাশি ব্যবস্থার অভাব
ফাঁসিদেওয়া গ্রামীণ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রবেশপথে একটি নীচু অংশ রয়েছে, যেখানে বৃষ্টির জল জমে থাকে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সিমেন্ট দিয়ে রাস্তাটি উঁচু করার কথা ছিল, কিন্তু সেই কাজ এখনও শুরু হয়নি। এছাড়া, নিকাশি ব্যবস্থার অভাব এই সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বারবার কর্তৃপক্ষের কাছে নিকাশি ব্যবস্থা তৈরির দাবি জানিয়েছেন, কিন্তু তাঁদের অভিযোগের কোনো সমাধান হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা রমেশ মাহালি বলেন, “এই হাসপাতালে আমাদের পরিবারের চিকিৎসা হয়। কিন্তু বৃষ্টি হলেই প্রবেশপথে জল জমে, যার ফলে রোগীদের ভোগান্তি বাড়ে। আমরা বারবার অভিযোগ করেছি, কিন্তু কেউ শোনেনি।” আরেক বাসিন্দা, সাবিনা খাতুন, বলেন, “জলের মধ্য দিয়ে হেঁটে হাসপাতালে যাওয়া খুবই কষ্টকর। এটা কি সরকারের ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্পের ফল? আমরা কি ‘দুয়ারে পচা জল’ পাব?”

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ফাঁসিদেওয়ার বিজেপি নেতা অনিল ঘোষ বলেন, “এর আগেও আমরা ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়ে সমস্যা সমাধানের দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তৃণমূল সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।” তিনি আরও বলেন, “এই অবস্থা ফাঁসিদেওয়ার মানুষের জন্য লজ্জাজনক। সরকারের উচিত অবিলম্বে এই সমস্যার সমাধান করা।”

অন্যদিকে, ফাঁসিদেওয়ার ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক ডা. শাহিনুর ইসলাম বলেন, “পূর্ত দপ্তরকে এই সমস্যা সমাধানের জন্য নির্মাণ কাজ শুরু করার কথা জানানো হয়েছে। কাজ শুরু হলে জল জমার সমস্যা মিটে যাবে।” তবে, তিনি কাজ শুরুর কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করেননি।

স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও সামাজিক প্রভাব
হাসপাতালের প্রবেশপথে জমা পচা জল কেবল ভোগান্তিই নয়, স্বাস্থ্য ঝুঁকিও তৈরি করছে। এই জলে মশা ও পোকামাকড়ের উৎপাত বাড়ছে, যা ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক রোগীদের জন্য এই পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক। স্থানীয় একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করে বলেন, “জলমগ্ন প্রবেশপথ রোগীদের জন্য অস্বাস্থ্যকর। এটি হাসপাতালের সুনাম নষ্ট করছে।”

Advertisements

সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছেন এলাকাবাসী। এক্স-এ একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “ফাঁসিদেওয়া হাসপাতালের এই অবস্থা দেখে লজ্জা লাগে। তৃণমূল সরকারের ‘দুয়ারে সরকার’ এখন ‘দুয়ারে পচা জল’ হয়ে গেছে।” আরেকজন লিখেছেন, “বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই এই অবস্থা। বর্ষায় কী হবে, ভাবতেই ভয় লাগে।”

সমাধানের দাবি
স্থানীয় বাসিন্দারা অবিলম্বে নিকাশি ব্যবস্থা তৈরি এবং প্রবেশপথের রাস্তা উঁচু করার দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, এই সমস্যা সমাধান না হলে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এছাড়া, তারা স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার জন্য তৃণমূল সরকারকে দায়ী করছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নিকাশি ব্যবস্থার অভাব এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে গ্রামীণ এলাকার হাসপাতালগুলোতে এই ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তারা পরামর্শ দিয়েছেন যে, স্থানীয় পঞ্চায়েত ও পূর্ত দপ্তরের সমন্বয়ে দ্রুত নির্মাণ কাজ শুরু করা উচিত। এছাড়া, হাসপাতালের আশপাশে জল নিষ্কাশনের জন্য স্থায়ী ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন।

বর্ষার আগে উদ্বেগ
বর্ষা এখনও পুরোপুরি শুরু হয়নি, তবু এই অবস্থা। স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, বর্ষায় জল জমার সমস্যা আরও তীব্র হবে। এই পরিস্থিতি হাসপাতালে রোগীদের ভর্তি এবং জরুরি চিকিৎসা সেবায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। স্থানীয় একজন শিক্ষক বলেন, “এই হাসপাতাল আমাদের গ্রামের একমাত্র ভরসা। কিন্তু এই অবস্থা চলতে থাকলে মানুষ বড় শহরের হাসপাতালে যেতে বাধ্য হবে, যা তাদের জন্য ব্যয়বহুল।”

ফাঁসিদেওয়া গ্রামীণ হাসপাতালের প্রবেশপথে জমা পচা জল রাজ্যের স্বাস্থ্য অবকাঠামোর দুর্বলতা এবং প্রশাসনিক উদাসীনতার একটি স্পষ্ট প্রমাণ। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমাতে এবং হাসপাতালের সেবার মান বজায় রাখতে অবিলম্বে নিকাশি ব্যবস্থা এবং রাস্তার সংস্কার প্রয়োজন। এই ঘটনা রাজ্য সরকারের ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্পের সাফল্যের পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকার উন্নয়নের ঘাটতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। এখন প্রশ্ন, এই সমস্যার সমাধান কবে হবে?