অয়ন দে, কোচবিহার: প্রতিবছরের মতো এবারও কোচবিহারে (Cooch Behar) অনুষ্ঠিত হল বহুল প্রতীক্ষিত ও ঐতিহ্যবাহী মদন মোহনের রথযাত্রা। তবে এবারের রথযাত্রা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ১৩৬ বছরের পুরনো কাঠের ঐতিহ্যবাহী রাজ আমলের রথের পরিবর্তে এই প্রথমবার ঠাকুর মদন মোহন যাত্রা করলেন একেবারে নতুন রথে।
কোচবিহারের (Cooch Behar) ভক্তদের কাছে মদন মোহনের রথযাত্রা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি আবেগ, ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিবছর রথের দিন ঠাকুর মদন মোহন নিজের মন্দির থেকে ডাঙ্গোরাই মন্দিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। দীর্ঘদিন ধরেই এই যাত্রা ছিল পুরনো কাঠের রাজ রথে। তবে রথের বয়সজনিত কারণে গত কয়েক বছরে তার কাঠামোতে একাধিক সমস্যা দেখা দেয়।
বহুবার সংস্কার করা হলেও শেষ পর্যন্ত ঐতিহাসিক রথের কাঠামো আর সুরক্ষিত রাখা সম্ভব হয়নি। ফলত, ভক্তদের নিরাপত্তা এবং রথের স্থায়িত্বের কথা মাথায় রেখে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মিত হলো একেবারে নতুন রথ।
জেলাশাসক অরবিন্দ কুমার মিনা-র নেতৃত্বে এই নতুন রথ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়। রথ তৈরিতে আধুনিক প্রযুক্তি এবং স্থায়িত্ব বজায় রাখার উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে রথের ডিজাইনে রাখা হয়েছে পুরনো রথের ছোঁয়া।
এদিন সকাল থেকেই কোচবিহার (Cooch Behar) শহরে ছিল উৎসবের আমেজ। ভোর থেকে ভক্তরা ভিড় জমান মদন মোহন মন্দির প্রাঙ্গণে। গানের সুর, ঢাকের বাদ্যি, শঙ্খধ্বনি আর ভক্তদের জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে সমগ্র এলাকা।
সকালে নতুন রথে ঠাকুরের প্রতিমা বসানো হয়। এরপর ঠিক নিয়ম মেনেই শুরু হয় রথযাত্রার শুভ সূচনা। জেলা শাসক অরবিন্দ কুমার মিনা স্বয়ং রথের দড়ি টেনে এই ঐতিহাসিক যাত্রার উদ্বোধন করেন। তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন মহুকুমা শাসক কুণাল ব্যানার্জি, কোচবিহার পৌরসভার পৌরপিতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, জেলা তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি অভিজিৎ দে ভৌমিক সহ অন্যান্য প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা।
রথের পথে উপচে পড়া মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। বহু ভক্ত দড়ি ধরে রথ টানার সৌভাগ্য অর্জনের আশায় হাজির হন। চারপাশে বাজতে থাকে মদন মোহনের নামকীর্তন, পরিবেশে মিশে যায় ধূপ, ফুল আর ভক্তির সুগন্ধ।
স্থানীয় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ছোট বড় সকলেই এই রথযাত্রাকে ঘিরে সাজিয়ে তোলে তাদের বাড়ি ও দোকান। শহরের বিভিন্ন মোড়ে পানীয় জল, তাজা ফল এবং প্রসাদের আয়োজন করা হয়।
এ বছর নতুন রথে মদন মোহনের যাত্রা দেখতে শুধু কোচবিহার থেকেই নয়, আশপাশের জেলা থেকেও বহু মানুষ ছুটে আসেন। তাদের সকলের মুখে ছিল একটাই কথা—”পুরনো স্মৃতির সঙ্গে এবার যুক্ত হল নতুন ইতিহাস।”
জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগের জন্য সাধুবাদ জানিয়েছেন কোচবিহারবাসী। অনেকেরই বক্তব্য, “পুরনো রথ ছিল আমাদের আবেগের অংশ, তবে নতুন রথের মাধ্যমে ঠাকুরের যাত্রা আরও নিরাপদ ও সুন্দর হল।”
এইভাবে কোচবিহার এবার নতুন এক অধ্যায়ের সাক্ষী থাকলো। রাজ আমলের ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধনে মদন মোহনের এবারের রথযাত্রা রচিত করলো ইতিহাসের এক নতুন পৃষ্ঠা।