অয়ন দে, কোচবিহার: স্বাধীনতার ৭৮ বছর পর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হল কোচবিহারের (CoochBehar) দিনহাটা-১ ব্লকের সীমান্তবর্তী খারিজা হরিদাস ও কোনামুক্তা গ্রাম। একইসঙ্গে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে গিতালদহ-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫৭টি পরিবারে। এতদিন পর জীবনে প্রথমবার আলো জ্বলে উঠতেই মুখে হাসি ফুটেছে এলাকাবাসীর। যেন বাস্তবে ফিরে এল শাহরুখ খানের ‘স্বদেশ’ সিনেমার সেই চরণপুর গ্রামের দৃশ্য।
এই গ্রামগুলো এতদিন কাঁটাতারের অপর পাশে থাকার দরুন প্রশাসনিক এবং পরিকাঠামোগত কারণে বিদ্যুৎ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত ছিল। অথচ তারা ভারতের নাগরিক, ভারতের মাটিতেই থাকেন, তবুও আধুনিক ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা—বিদ্যুৎ—পাওয়া ছিল স্বপ্নের মতো। সেই স্বপ্নই এবার বাস্তবে রূপ নিল।
স্থানীয় গিতালদহ-১ পঞ্চায়েত সদস্য আশাদুল হক জানান, “সীমান্তবর্তী এই পরিবারগুলো বহু বছর ধরে প্রাথমিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিদ্যুৎ পরিষেবা চালু করার জন্য বিডিও, বিএসএফ ও রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার সঙ্গে লাগাতার যোগাযোগ করতে হয়েছে। পাঁচ বছরের চেষ্টার ফল আজ সফল হয়েছে।”
রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা (WBSEDCL)-র তরফে জানানো হয়েছে, সীমান্তে কাঁটাতার পেরিয়ে পাঁচটি বৈদ্যুতিক খুঁটি বসানো হয়েছে। নদীর উপর দিয়েও বৈদ্যুতিক তার নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যাতে খারিজা হরিদাস ও কোনামুক্তা গ্রামের প্রতিটি বাড়ি বিদ্যুৎ সংযোগ পায়। এটি ছিল একেবারেই চ্যালেঞ্জিং কাজ, বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার কারণে আলাদা সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছে।
এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এতদিন মোমবাতি বা কেরোসিন ল্যাম্পই ছিল একমাত্র আলো। স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাদের পড়াশোনা বা রাতে নিরাপত্তা—সব কিছুই ছিল অনিশ্চিত। বিদ্যুৎ আসার ফলে শুধু আলোর অভাব মিটল না, বরং বদলে যেতে শুরু করল জীবনযাত্রার মান। টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল চার্জিংসহ নানান আধুনিক সুবিধার দুয়ার এবার খুলে গেল এই প্রান্তিক মানুষের সামনে।
কোনামুক্তা গ্রামের বাসিন্দা হালিমা খাতুন বলেন, “আমার ছেলে এখন পড়াশোনায় আরও মনোযোগ দিতে পারছে। আগে মোমবাতির আলোয় বই পড়ত, চোখের ওপর চাপ পড়ত। এখন ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে, আমরা যেন নতুন জীবন পেয়েছি।”
এই উদ্যোগে বিএসএফ-এর ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। নিরাপত্তার খাতিরে সীমান্তে যেকোনো পরিকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিএসএফ-এর অনুমতি প্রয়োজন হয়। তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া এত বড় কাজ সম্ভব হতো না।
এই সাফল্যের পর অন্যান্য কাঁটাতার ঘেরা গ্রামগুলিতেও বিদ্যুৎ পৌঁছানোর আশা তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, পর্যায়ক্রমে সব সীমান্তবর্তী গ্রামেই বিদ্যুৎ পরিষেবা চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
শেষমেশ, স্বাধীনতার আট দশক পর আলো পেলেও, এই অপেক্ষা যে কতখানি দীর্ঘ এবং লজ্জাজনক, তা অস্বীকার করা যায় না। তবে আশার কথা এই, সীমান্তের এই আলো এখন এক নতুন দিশা দেখাচ্ছে, যেখানে উন্নয়নের আলোয় আলোকিত হবে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি কোণ।