কলকাতা: ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (SIR) নিয়ে রাজ্য জুড়ে তৎপরতা তুঙ্গে। ৪ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে বাড়ি বাড়ি এনিউমারেশন ফর্ম বিলির কাজ। বুথ লেভেল অফিসাররা (BLO) এই কর্মসূচির মূল দায়িত্বে রয়েছেন। অফলাইনে বাড়ি গিয়ে ফর্ম বিলি ও জমা নেওয়ার পাশাপাশি অনলাইনেও আবেদনপত্র পূরণের সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে প্রক্রিয়া শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই বিভিন্ন জেলা থেকে অনিয়ম ও পক্ষপাতের গুরুতর অভিযোগ উঠে আসতে শুরু করেছে।
নির্বাচন কমিশনের (Election Commission) কাছে খবর পৌঁছেছে, একাধিক BLO বাড়ি বাড়ি না গিয়ে রাজনৈতিক দলের ক্যাম্পে বসে ফর্ম বিলি করছেন, কোথাও আবার নির্দিষ্ট এক জায়গা থেকে আবেদন সংগ্রহ করা হচ্ছে, এমনকি পক্ষপাতমূলক আচরণ করে কিছু নাগরিককে পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগও আসছে। কোথাও আবার ফর্ম বণ্টনে সহযোগিতা করতে গিয়ে সরাসরি রাজনৈতিক দলের এজেন্টদের সঙ্গে BLO-দের যোগাযোগের অভিযোগও উঠেছে।
এই খবর প্রকাশ্যে আসার পর নড়েচড়ে বসে কমিশন। শনিবার নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ৮ জন BLO-কে শোকজ নোটিস পাঠানো হয়েছে এবং ৫ জন BLA (বুথ লেভেল এজেন্ট)-এর বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। কমিশনের তরফে এটাও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, যদি কোনও BLO ইচ্ছাকৃতভাবে ফর্ম নষ্ট করেন, তথ্য গোপন করেন বা কোনও রাজনৈতিক দল বা এজেন্টের সঙ্গে যোগসাজশে ভোটার তালিকা প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন, তবে তাঁর বিরুদ্ধেও এফআইআর দায়ের করা হবে।
নির্বাচন কমিশনের এক আধিকারিক জানান, “BLO-দের প্রধান এবং একমাত্র দায়িত্ব ভোটার তালিকা সংশোধনের প্রক্রিয়াকে নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করা। এই কাজে কোনও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পক্ষপাত বা গাফিলতি সহ্য করা হবে না। অভিযোগ পেলেই সংশ্লিষ্ট আধিকারিককে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এবং বিভাগীয় তদন্ত শুরু করা হবে।”
এর পাশাপাশি কমিশন নাগরিকদের জন্য অভিযোগ জানানোর সরাসরি পথ খুলে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ যদি দেখেন কোনও BLO বাড়ি বাড়ি আসছেন না, নির্দিষ্ট জায়গা থেকে ফর্ম দিচ্ছেন, রাজনৈতিক পক্ষপাত দেখাচ্ছেন অথবা আবেদন গ্রহণে গড়িমসি করছেন, তাহলে নির্বাচন কমিশনে সরাসরি অভিযোগ জানানো যাবে।
এই লক্ষ্যে চালু করা হয়েছে হেল্পলাইন নম্বর— 033-22310850। সকালে থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই নম্বরে ফোন করে অভিযোগ নথিভুক্ত করা যাবে। কমিশন জানিয়েছে, কন্ট্রোল রুমে অভিযোগ এলেই দ্রুত তা খতিয়ে দেখা হবে এবং প্রমাণ পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে উত্তরবঙ্গে SIR কার্যক্রম তদারকি করতে ইতিমধ্যেই জাতীয় নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধি দল রাজ্যে এসেছে। পরিদর্শনের সময় তাঁরা BLO-দের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন— বাড়ি বাড়ি গিয়েই এনিউমারেশন ফর্ম দিতে হবে, কোনওভাবেই BLA বা রাজনৈতিক এজেন্টের হাতে ফর্ম তুলে দেওয়া যাবে না, ভোটারদের সঠিক তথ্য জানাতে হবে, বিভ্রান্ত করা চলবে না, প্রতিটি নাগরিকের অ্যাপ্লিকেশন নিরপেক্ষভাবে গ্রহণ করতে হবে।
SIR নিয়ে নানা গুজব, ভুল তথ্য এবং ভয় থেকেও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে বলে কমিশন জানিয়েছে। তাই সোমবার থেকে সংবাদমাধ্যম, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং স্থানীয় প্রচার ব্যবস্থার মাধ্যমে জোরদার সচেতনতামূলক প্রচার শুরু করা হবে। উদ্দেশ্য একটাই প্রত্যেকে যেন পরিষ্কার বোঝেন, SIR ভোটার বাদ দেওয়ার কর্মসূচি নয়, বরং নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরির একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভোটার তালিকার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় না থাকলে গণতন্ত্রের ভিত্তিই দুর্বল হয়। সেই কারণেই নির্বাচন কমিশনের এই কঠোর পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞদের কথায়, “BLO হলেন ভোটার তালিকার মেরুদণ্ড। তাঁদের কাজ যদি নিরপেক্ষ না হয়, তাহলে তার প্রভাব সরাসরি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় পড়তে পারে। তাই কমিশনের কঠোর অবস্থান সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয়।”


