সন্দেশখালির মুখ বিজেপির রেখা পাত্রর গ্ল্যামার নেই, লড়াই আছে

‘প্রতিবাদ করছি’, বিষয়টা সিনেমা সাহিত্যে যতটা সহজ বাস্তবে কিন্তু ততটাই কঠিন। বিশেষ করে এমন একটা জায়গায় যেখানে নদী পেরিয়ে গেলে অন্য পৃথিবীতে পৌঁছে যেতে হয়।…

‘প্রতিবাদ করছি’, বিষয়টা সিনেমা সাহিত্যে যতটা সহজ বাস্তবে কিন্তু ততটাই কঠিন। বিশেষ করে এমন একটা জায়গায় যেখানে নদী পেরিয়ে গেলে অন্য পৃথিবীতে পৌঁছে যেতে হয়। যেখানে সন্ধ্যে ৬টায় ভোলাখালি ঘাট থেকে শেষ নৌকটা সন্দেশখালির উদ্দেশ্যে ছাড়লেই আপনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে না চাইতেও যে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন৷

সন্দেশখালিতে তাই নিজের মতো মুঘল সাম্রাজ্য গড়েও উঠেছিল। বাম আমলে সন্দেশখালির একটা ‘জাহাঙ্গীর’ ছিল, যার নাম মোসলেম শেখ। তারপর তার হাত ধরেই আসে শাহজাহান। সে সময় মোসলেমের সাগরেদ ছিল শাহজাহান। ২০১১-র পর শাহজাহান তৃণমূলে যোগ দেয়। সংবাদমাধ্যমে সন্দেশখালির মেয়েরায় অভিযোগ করেছেন, জমি, মাটি, জল, মাছ তো দূর সন্দেশখালিতে শরীরের মাংসের উপরও যেন অলিখিত অধিকার ছিল শাহজাহান ও তার বিশাল বাহিনী। মেয়েদের রাতে পার্টি অফিস বা পিঠে বানাতে ডেকে নিয়ে যাওয়ার কথা তো আপনারা এতদিনে সংবাদমাধ্যমে সন্দেশখালির মেয়েদের মুখ থেকেই শুনে নিয়েছেন৷

এ হেন শাহজাহানের বিরুদ্ধে লড়াই করা মানে একটা মোঘল সাম্রাজকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া। এটা যাদবপুরে ৮বির সামনে দাঁড়িয়ে গাজায় ইজরায়েলি হানা নিয়ে প্রতিবাদ নয়। শ্যামাপ্রসাদের মূর্তিতে কালি মাখিয়ে কাল্পনিক সাম্রাজ্যবাদী শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা নয়। সন্দেশখালির লড়াই আন্দোলন যাই বলুন সেটা ছিল জলে থেকে নীল তিমি ও তার সাগরেদ হাঙরদের সঙ্গে লড়াই করা। প্রতিবাদে টুঁ শব্দটি করলে পরেরদিন পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলীন হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল৷ তারপরও রেখা পাত্র-রা লড়াই করার প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছেন৷ জীবনের পরোয়া না করে এগিয়ে এসে রুখে দাঁড়িয়েছেন৷ দেশ স্বাধীন হয়েছিল ১৯৪৭ এ সন্দেশখালিকে শাহজাহানদের হাত থেকে স্বাধীনতা দিতে আজও লড়ে যেতে হচ্ছে রেখা পাত্রদের।

রেখা পাত্র ট্রেনড নন, উনি যাদবপুরীয়ান বা রাজধানী শহরের ডন কুইক্সোট নন, উনি উইন্ডমিলের কাল্পনিক শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে নামেননি৷ রেখা পাত্রকে লড়তে হয়েছে খাবারের জন্য, নোনা জলে শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য, শাহজাহান গ্যাং-এর লালসা থেকে বেঁচে থাকার জন্য, সন্দেশখালির মেয়েদের বাঁচানোর জন্য। রেখা পাত্রর বেঁচে থাকাটাই একটা বিপ্লব। তাই উনি আলাদা করে কাফকা, মান্টো পড়তে পারেননি, আঙুলের ফাঁকে সিগারেট ধরে কিংবা ল্যাম্পপোস্টোর নীচে শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে মধ্যমা দেখিয়ে মমতাশঙ্কর কী বললেন তার প্রতিবাদ জানাতে পারেননি! এমনকি নবারুণ ভট্টাচার্যের উড়ন্ত সব কবিতা পড়ে দেখেননি হয়ত!

তাই রেখা পাত্র টিভি ডিবেটে বসে সে সব কথা বলতে পারবেন না, যা মীনাক্ষী মুখার্জি নিশ্চিত স্যালারির ডিউটিহীন চাকরি করে মঞ্চ থেকে বলতে পারেন কিংবা রাজন্যাদেবী দেবী একুশের মঞ্চ থেকে যে স্লোগান বানিয়ে ছুঁড়ে দেন সেই গ্ল্যামারের ধারপাশ দিয়ে হাঁটতে পারবেন না রেখা পাত্র৷

যখন আমি এই প্রতিবেদনটা লিখছি কিংবা আপনি পড়ছেন তখন হয়ত রেখা পাত্র কোথাও সন্দেশখালির মেয়েদের সাহস দিচ্ছেন যাতে সন্দেশখালিতে আরও একটা শাহজাহান শিবু হাজরা তৈরি না হয়। হয়ত বা কখনও চিন্তিত হচ্ছেন আইনের ফাঁক গলে শাহজাহান আবার ফিরবে না তো! হয়ত সন্দেশখালির কোনও বাচ্চা মেয়ে বা ছেলেকে স্কুল ড্রেস পরিয়ে দিচ্ছেন যাতে শিক্ষাটা তার মেরুদণ্ড পর্যন্ত পৌঁছতে পারে, হয়ত কোদাল হাতে সন্দেশখালির জমির আলগুলোগুলো চওড়া করছেন যাতে আর কেউ তাতে নোনাজল ঢুকিয়ে ফসল নষ্ট না করতে পারে!

যারা কখনও ঝর্না দেখেনি, খরস্রোত দেখেনি,
শুধু বাড়ির শাওয়ার নীচে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে ভেবেছে হুঁড্রু আর এর চেয়ে বড় কী হবে তারা আন্দোলন বুঝবে না। সারা দেশে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে নেতাদের উঠে আসার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সব দলের জন্য বিজেপি, সিপিএম, তৃণমূল, কংগ্রেস। এমন নেতা নেত্রী যারা মাটিটা বুঝে মাটির উপর দাঁড়িয়ে মানুষের জন্য লড়াই করবে, ২২ লাখি গাড়ি চড়ে টিভি ডিবেটে অংশ নিতে নিতে একদিন নেতা হয়ে উঠবেন না৷

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক নির্বাচনে রেখা পাত্ররা লড়বেন না তো কারা লড়বেন?
বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে রেখা পাত্র ভারতীয় জনতা পার্টির জন্য অবশ্যই নির্বাচনী কভারড্রাইভ।