কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে নীরব পরিবর্তন হয়ে গেল। ঐতিহ্যবাহী দার্জিলিং (Darjeeling) পুরসভা ও পাহাড়ি রাজনীতির ভরকেন্দ্র গোর্খা রাজনীতিতেই ধাক্কা লেগেছে পুরভোটের ফলাফলে। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা থেকে (গোজমুমো) এভাবে শৈলশহরবাসী মুখ ঘুরিয়ে নেবেন তা আঁচ করতে পারেনি শাসক টিএমসি ও তাদের সহযোগী বিমল গুরুংপন্থীরা। পুরসভা ভোট ফলাফলে স্পষ্ট মোর্চার গুরুংপন্থী, তাদের বিরোধী মোর্চার অপর গোষ্ঠী বিনয় তামাংপন্থীরা সবাই ব্রাত্য ।
পুরসভার ভোটের সামগ্রিক ফলাফলে দার্জিলিংয়ের রাজনৈতিক ক্ষমতা হারাল গোজমুমো। উঠে এসেছে হামরো পার্টি। এর সঙ্গে অনেকটা প্রাক্তন ভারতীয় ফুটবল দল অধিনায়ক বাইচুং ভুটিয়ার দল ‘হামরো সিকিম’ নামের সঙ্গে মিল রয়েছে। কিন্তু দুটি-ই আলাদা নীতি নিয়ে চলে। বাইচুং সিকিমের রাজনীতিতে জড়িত।
পুরসভা ভোটের ফলে দার্জিলিং পুরবোর্ড হামরো পার্টির দখলে। দলটির সভাপতি অজয় এডওয়ার্ড এখন দার্জিলিংয়ের ক্ষমতার কেন্দ্রে। তবে এডওয়ার্ড হেরেছেন। কিন্তু হামরো পার্টি ক্ষমতায়।
পুরসভা ভিত্তিক ফলাফল দার্জিলিংকে ফের আলোচনায় এনেছে। গোজমুমো ও তৃণমূল কংগ্রেস জুটি, বিজেপি, অন্যান্য গোর্খা রাজনৈতিক দলগুলিকে যেভাবে বোতাম টিপে বিদেয় করেছেন শহরটির বাসিন্দারা তাতে চমক রাজ্য জুড়ে।
প্রাথমিক বিশ্লেষণে উঠে আসছে, পাহাড়ি ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে মোর্চার বারবার পক্ষ বদলে বীতশ্রদ্ধ দার্জিলিংবাসী বিকল্প রাজনৈতিক মঞ্চ বেছে নিলেন।
বিশ্লেষণে আসছে, গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে ক্ষমতার চাবিকাঠি করে গোজমুমো কখনও টিএমসি কখনও বিজেপির শিবিরে যাওয়ার কৌশল আর নিতে চাইছেন না দার্জিলিংবাসী। ভয়াবহ রাজনৈতিক উগ্রতা না পসন্দ এও বার্তা দিলেন দার্জিলিংবাসী। সদ্য গঠিত হওয়া হামরো পার্টি আপাতত উগ্র রাজনীতির বাইরে। ফলে তাদের ঝুলি ভরেছে।
আশির দশকে বামফ্রন্ট জমানায় রক্তাক্ত গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের জেরে ততকালীন ‘দার্জিলিংয়েশ্বর’ সুবাস ঘিসিং যে জিএনএলএফ দলকে ক্ষমতার স্বাদ দিয়েছিলেন সেই ধারার পরবর্তী নেতা বিমল গুরুং। তিনি ঘিসিং ছায়া থেকে বের হতে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা গঠন করেন। ঘিসিংকে সরে যেতে হয়।
গুরুংয়ের রাজনীতিও রক্তাক্ত হয়েছে বারবার। পাহাড়ি রাজনীতির অতি গুরুত্বপূর্ণ নেতা তথা অখিল ভারতীয় গোর্খা লিগ প্রধান মদন তামাংকে প্রকাশ্যে খুন করা হয়। মোর্চার সরাসরি ইন্ধনে এমনটা হয়েছিল বলে অভিযোগ।
মদন তামাং খুনের পরবর্তী সময়ে বারবার গুরুং সংঘাতে গেছে রাজ্য সরকার। গুরুং পলাতক হন। বিজেপির আশ্রয়ে রাজনৈতিক অস্তিত্ব বজায় রাখেন। ফের তৃণমূলের বদান্যতায় ফিরে আসেন। ততদিনে গোজমুমো বিভক্ত। নরমপন্থী বিনয় তামাং সাময়িক ক্ষমতার কেন্দ্রে এলেও তিনিও টিএমসি, বিজেপিতে একইসাথে সু-সংযোগ রেখে চলেছেন। এরকম পরিস্থিতিতে দার্জিলিং থেকে আর যে সব দলগুলি বিজেপির সঙ্গে জড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রেখেছে তারাও ক্রমে জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে। রাজনীতির অলিগলিতে ঘুরে তৈরি হয়েছে হামরো পার্টি।
দীর্ঘ নির্বাসন কাটিয়ে গত বিধানসভা ভোটের আগে দার্জিলিং ফিরেছিলেন গুরুং। বিরাট জনসভা থেকে হুমকি দিয়েছিলেন বিনয় তামাংকে দার্জিলিং ছাড়া করবেন। করতে পারেননি। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর গরম ইমেজ ধাক্কা খেয়েছে। গুরুং-তামাং বিরোধিতা, ফের হাত মিলিয়ে নেওয়ার মধ্যে অজয় এডওয়ার্ডের উঠে আসা রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিতে চলেছে।
গুরুং কি ফের গরম হবেন পুরসভা ভোটের পর? দার্জিলিংয়ে আরও একটা মদন তামাংয়ের মতো কারোর লাশ পড়ে থাকার সম্ভাবনা প্রবল।