বিদেশে বসবাসকারী বহু ভারতীয় (NRI), বিশেষ করে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে রয়েছেন, তাঁদের কাছে দেশের মাটিতে একটি সম্পত্তি কেনা শুধু আর্থিক বিনিয়োগ নয়, বরং আবেগের সঙ্গে জড়িত এক বিশেষ সিদ্ধান্ত। অনেকেরই ধারণা, ভারতে একটি ফ্ল্যাট কেনা মানেই ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ সঞ্চয়, নিয়মিত ভাড়ার আয় এবং দীর্ঘমেয়াদে মূলধনের প্রশংসা। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা সব সময় এমন হয় না। সম্প্রতি এমনই একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয় ফোরাম Reddit-এর rupeestories সাবরেডিটে, যা এখন আলোচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
২০১০ সালে শুরু, ২০২4-এ হতাশাজনক সমাপ্তি
২০১০ সালে এক NRI দম্পতি হায়দরাবাদের নামকরা এলাকা নানাকরামগুডায় Mantri Celestia কমপ্লেক্সে একটি ৩BHK ফ্ল্যাট কিনেছিলেন ₹৬৪.৩৪ লক্ষ টাকায়। তাঁদের পরিকল্পনা ছিল সোজা: বাড়ির দাম বাড়বে, আর এই সময়ে ভাড়া থেকেও কিছু আয় হবে। কিন্তু বাস্তবে এই স্বপ্ন সফল হয়নি।
দম্পতির বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁরা নির্মাণাধীন ফ্ল্যাটটির জন্য ধাপে ধাপে ৯ বছরে ₹৫৯.৩৪ লক্ষ পরিশোধ করেন। পাশাপাশি ₹৫ লক্ষ খরচ হয় কাঠের কাজ ও মেরামতের পেছনে। নির্মাণে দীর্ঘ বিলম্বের কারণে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ফ্ল্যাটের দখল পাননি তাঁরা।
১৫ বছরে ২৬% রিটার্ন, কিন্তু ডলারে লাভ প্রায় কিছুই নয়
শেষমেশ, ২০২৪ সালে ফ্ল্যাটটি বিক্রি করেন ₹৯০ লক্ষ টাকায়। এজেন্ট কমিশন ও ক্যাপিটাল গেইনস ট্যাক্স বাদে হাতে পান ₹৮৪.৯ লক্ষ। ২০১৯ থেকে ২০২৪—এই পাঁচ বছরে ভাড়া বাবদ ₹১২ লক্ষ পেলেও খরচ ও কর বাদে নেট আয় মাত্র ₹৭.২ লক্ষ।
সব মিলিয়ে টাকার হিসেবে লাভ দাঁড়ায় ₹২৮.৯ লক্ষ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ডলারে রূপান্তর করলে সেই লাভ প্রায় উধাও। ২০১০ সালে ₹৬৪.৩৪ লক্ষ মানে ছিল প্রায় $১,১১,৭৪০ (তৎকালীন ₹৪৫/$ রেটে)। ২০২৪ সালে ₹৯০ লক্ষ মানে ছিল প্রায় $১,২০,০০০ (প্রায় ₹৮৫/$ রেটে)। অর্থাৎ ১৫ বছরে নেট লাভ মাত্র $৮,৫০০—বাৎসরিক গড় রিটার্ন মাত্র ০.৫ শতাংশ!
সুযোগের খরচ ছিল বিপুল
এই রিটার্ন এতটাই কম যে, যদি সেই একই অর্থ তারা ধাপে ধাপে একটি মার্কিন S&P 500 ইনডেক্স ফান্ডে (যেমন SPY) বিনিয়োগ করতেন, তবে তাঁদের পোর্টফোলিওর বর্তমান মূল্য হতে পারত $৩,৩০,০০০-র বেশি। বাস্তবে তারা যা পেল, তা সেই সম্ভাব্য রিটার্নের মাত্র এক-তৃতীয়াংশেরও কম। অর্থাৎ তারা প্রায় ₹১.৮ কোটি টাকার সমমূল্যের সম্ভাব্য লাভ হারিয়েছেন।
আবেগের চেয়ে বাস্তব মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ
এই দম্পতির অভিজ্ঞতা শুধু অর্থনৈতিক নয়, মানসিক দিক থেকেও অত্যন্ত ক্লান্তিকর ছিল বলে তাঁরা জানান। প্রবাসে বসে ভাড়াটিয়া সামলানো, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, কর ফাইলিং এবং ফ্ল্যাট বিক্রির জটিলতা—সব মিলিয়ে প্রচুর সময় ও মানসিক পরিশ্রম খরচ হয়েছে। তাঁরা বলেন, “বাড়ি বিক্রি করাটাই আমাদের সবচেয়ে বড় বিজয় মনে হয়েছে। এর চেয়ে মার্কেট ফান্ডে ইনভেস্ট করলেই ভাল হত।”
নানাকরামগুডা: প্রতিশ্রুতি অনেক, বাস্তবতা কম
যদিও এলাকাটি তথাকথিত হায়দরাবাদের “আইটি করিডোর”-এর অংশ, তবুও কাঙ্ক্ষিত হাইটেক সিটির মতো পরিকাঠামোগত উন্নতি এখানে হয়নি। ফলে ফ্ল্যাটের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি। এমনকি বিক্রি করতেও বেশ সময় লেগেছে, যা আবার প্রমাণ করে যে ভারতের রিয়েল এস্টেট লিকুইডিটি কম, বিশেষ করে বিদেশ থেকে পরিচালনার ক্ষেত্রে।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন, এনআরআইদের জন্য ভারতের আবাসন বাজারে বিনিয়োগ মানে সবসময় লাভজনক হবে এমন নয়। সঠিক রিসার্চ, সময়সীমা, প্রত্যাশিত রিটার্ন এবং মুদ্রা বিনিময় হারের কথা মাথায় রেখে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
এই অভিজ্ঞতা কেবল একটি পরিবারের নয়, বহু এনআরআই বিনিয়োগকারীর প্রতিনিধিত্ব করে। আবেগ দিয়ে নয়, আর্থিক যুক্তি ও ভবিষ্যতের হিসেব করে তবেই ভারতীয় সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করা উচিত। না হলে লাভের আশায় করা বিনিয়োগ একসময় বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে।