ভারতের কৃষি খাত, যা দেশের অর্থনীতির একটি মূল ভিত্তি এবং ১৮% জিডিপিতে অবদান রাখে, ২০২৫ সালে সার সংকটের (Fertilizer Shortage)মুখোমুখি হয়েছে। বিশেষ করে ইউরিয়া এবং ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি)-এর তীব্র ঘাটতি কৃষকদের উৎপাদনশীলতা এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম সার ভোক্তা দেশগুলির মধ্যে একটি, এবং ২০২৪-২৫ মৌসুমে সারের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সংকট আরও প্রকট হয়েছে। এই প্রতিবেদনে ভারতের সার সংকটের কারণ, কৃষকদের উপর এর প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হল।
সার সংকটের কারণ
ভারতের সার সংকটের মূল কারণ হল আমদানি নির্ভরতা এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অপর্যাপ্ততা। ভারত ইউরিয়ার ২০%, ডিএপি-এর ৫০-৬০%, এবং মিউরিয়েট অফ পটাশ (এমওপি)-এর ১০০% আমদানির উপর নির্ভরশীল। ২০২৪ সালে চীনের সার রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারতের আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। ২০২৩-২৪ সালে চীন থেকে ২১.৫ লাখ টন ইউরিয়া এবং ২২.৯ লাখ টন ডিএপি আমদানি হলেও, ২০২৪-২৫ সালে এটি মাত্র ১ লাখ টন ইউরিয়া এবং ৮.৪ লাখ টন ডিএপি-তে নেমে আসে। এছাড়া, ইউক্রেন এবং গাজার সংঘাত, রেড সি রুটে বাধা এবং বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের বিঘ্ন সংকটকে আরও জটিল করেছে।
২০২৪ সালে ভালো বর্ষার কারণে খরিফ ফসলের আবাদ বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে ধান এবং ভুট্টার, যা ইউরিয়ার চাহিদা বাড়িয়েছে। তবে, সরকার চাহিদার এই ঊর্ধ্বগতির জন্য প্রস্তুত ছিল না। ১ আগস্ট ২০২৪-এ ইউরিয়ার মজুদ গত বছরের তুলনায় ৫৭% কম ছিল। অপর্যাপ্ত স্টোরেজ এবং পরিবহন ব্যবস্থাও সার বিতরণে বিলম্ব ঘটিয়েছে, যা কৃষকদের জন্য সমস্যা বাড়িয়েছে।
কৃষকদের উপর প্রভাব
সারের ঘাটতি কৃষকদের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে কৃষকরা দীর্ঘ সারি, কালোবাজারি এবং অতিরিক্ত দামের সম্মুখীন হচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, গঞ্জাম জেলায় ইউরিয়ার দাম ৪৫ কেজির ব্যাগ প্রতি ২৬৬.৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০০-৭০০ টাকা হয়েছে। এই সংকটের ফলে ফসলের ফলন কমে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে, বিশেষ করে ধান, গম এবং সরিষার মতো ফসলের জন্য, যা ভারতের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় ডিএপি ঘাটতি ২.৪ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে। এই ঘাটতি কৃষকদের আর্থিক চাপ বাড়িয়েছে, কারণ ডিএপি-এর দাম ২০২৪ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১% বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক কৃষক, বিশেষ করে ছোট ও প্রান্তিক কৃষক, সার কিনতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন, যা তাদের জীবিকা এবং দেশের খাদ্য উৎপাদনের উপর হুমকি সৃষ্টি করছে। পশ্চিমবঙ্গে, কৃষকরা স্থানীয় বিতরণ কেন্দ্রে সারের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছেন, এবং কিছু ক্ষেত্রে পুলিশের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়েছে।
সরকারি পদক্ষেপ ও সমাধান
ভারত সরকার এবং আরবিআই সংকট মোকাবেলায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২৫ সালে চীনের সার রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর ভারত আমদানি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এছাড়া, সৌদি আরব এবং মরক্কোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সরবরাহ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সরকার ডিএপি-এর পরিবর্তে এনপিকে (নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম) সার ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে। হরিয়ানায় ৬০,০০০ মেট্রিক টন এনপিকে সরবরাহ করা হয়েছে, যার মধ্যে ২৯,০০০ মেট্রিক টন বিতরণ করা হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হিসেবে, সরকার ন্যানো ইউরিয়া এবং জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছে। ২০২১ সালে ইন্ডিয়ান ফার্মার্স ফার্টিলাইজার কো-অপারেটিভ (আইএফএফসিও) ন্যানো ইউরিয়া চালু করে, যা প্রচলিত ইউরিয়ার চাহিদা ৫০% কমাতে পারে। এছাড়া, মাটি পরীক্ষা এবং সরাসরি সুবিধা হস্তান্তর (ডিবিটি) মাধ্যমে সরকার কৃষকদের সার ব্যবহারে ভারসাম্য আনতে উৎসাহিত করছে। তবে, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং নীতিগত অনিশ্চয়তা এই প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
বাংলার প্রেক্ষাপট
পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে ধান এবং শাকসবজি প্রধান ফসল, সার সংকট কৃষকদের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর। স্থানীয় বিতরণ কেন্দ্রগুলিতে সারের অভাব এবং কালোবাজারি কৃষকদের ব্যয় বাড়িয়েছে। রাজ্য সরকার কৃষকদের সহায়তার জন্য সার বিতরণে কঠোর নজরদারি এবং জরিমানার ব্যবস্থা করেছে। তবে, কৃষক সংগঠনগুলি আরও কার্যকর বিতরণ ব্যবস্থা এবং স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে।
ভারতের সার সংকট ২০২৫ সালে কৃষকদের জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমদানি নির্ভরতা, অপর্যাপ্ত অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের বিঘ্ন এই সংকটের মূল কারণ। সরকারের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ এবং দীর্ঘমেয়াদী কৌশল, যেমন ন্যানো সার এবং জৈব চাষের প্রচার, এই সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য, সারের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ এবং সাশ্রয়ী মূল্য নিশ্চিত করা জরুরি। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকার, ফিনটেক এবং কৃষক সংগঠনগুলির সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।