মিলন পণ্ডা, কাঁথি: পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমা খটি মৎস্যজীবী উন্নয়ন সমিতির (Khati Matsyajibi Unnayan Samiti) সভাপতি পরিবর্তন নিয়ে তীব্র দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছে। এই ঘটনায় সমিতির বর্তমান সভাপতি তথা কাঁথি ১ ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী দলনেতা আমিন সোহেল মিটিংয়ের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তিনি এই পরিবর্তনকে অবৈধ বলে আখ্যা দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, সভাপতি পরিবর্তন বা নতুন সভাপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সরকারি প্রক্রিয়া মানা হয়নি। কাঁথি শহরের সৃঞ্জনী লজে সমিতির বিশেষ সাধারণ সভায় এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে, এবং এই ঘটনা মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র আলোচনার সৃষ্টি করেছে।
দ্বন্দ্বের পটভূমি
কাঁথি মহকুমা খটি মৎস্যজীবী উন্নয়ন সমিতি দীর্ঘদিন ধরে মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার জন্য কাজ করে আসছে। সমিতির লক্ষ্য হলো সরকারি প্রকল্পগুলি, বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক উদ্যোগ, গরিব মৎস্যজীবীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তবে, সম্প্রতি সমিতির সভাপতি পরিবর্তন নিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সৃঞ্জনী লজে আয়োজিত বিশেষ সাধারণ সভায় নতুন সভাপতি হিসেবে জলধা মৎস্য খটির অনন্ত কুমার বেরাকে নির্বাচিত করা হয়েছে। এছাড়া, ১৩ জনের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে, যার মধ্যে পাঁচজন মহিলা সদস্য রয়েছেন। সম্পাদক পদে লক্ষ্মী নারায়ণ জানা, সহ-সভাপতি হিসেবে অজয় বর, সহ-সম্পাদক শেখ নজরুল এবং কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দেবব্রত মণ্ডল নির্বাচিত হয়েছেন।
বিশেষ সভায় বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছর ধরে সমিতির সভাপতি হিসেবে একজন অ-মৎস্যজীবী ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করছেন, যাঁর কাজে সাধারণ মৎস্যজীবীরা সন্তুষ্ট নন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে নতুন কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে, এই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বর্তমান সভাপতি আমিন সোহেল।
আমিন সোহেলের অভিযোগ
কাঁথিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে আমিন সোহেল দাবি করেছেন যে, সমিতির সম্পাদক এককভাবে এই মিটিং ডেকেছেন, যা নিয়মবহির্ভূত। তিনি বলেন, “সম্পাদকের এভাবে মিটিং ডাকার কোনো অধিকার নেই। মিটিং ডাকার ক্ষমতা সভাপতির হাতে। আমি বিভিন্ন মৎস্য খটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, বেশিরভাগ মৎস্যজীবী এই সভার বিষয়ে কিছুই জানেন না। শুধুমাত্র গুটিকয়েক মৎস্যজীবীকে নিয়ে এই মিটিং করা হয়েছে এবং নতুন কমিটি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।”
আমিন আরও জানান, সভাপতি পরিবর্তন বা নতুন কমিটি গঠনের জন্য সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে সভাপতির তরফে সাত দিন আগে চিঠি দিয়ে মিটিংয়ের ঘোষণা করা, মৎস্য দপ্তরের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ভোটাভুটির মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। তিনি অভিযোগ করেন, এই ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম মানা হয়নি। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “এই মিটিং কি ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আয়োজিত হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।”
মৎস্যজীবীদের প্রতিক্রিয়া
আমিন সোহেলের অভিযোগের পর মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এই ধরনের অবৈধ প্রক্রিয়ায় সভাপতি পরিবর্তন মৎস্যজীবীদের স্বার্থের পরিপন্থী। আমিন জানিয়েছেন, তিনি শীঘ্রই সমিতির একটি বৈধ মিটিং ডাকবেন এবং সাধারণ মৎস্যজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। তিনি বলেন, “কাঁথি মহকুমা খটি মৎস্যজীবী উন্নয়ন সমিতি কারও ব্যক্তিগত সংস্থা নয়। এটি মৎস্যজীবীদের জন্য কাজ করে। এভাবে অবৈধভাবে সভাপতি পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়।”
সমিতির নতুন কমিটি
সৃঞ্জনী লজে আয়োজিত সভায় গঠিত নতুন কমিটির সদস্যরা হলেন:
- সভাপতি: অনন্ত কুমার বেরা (জলধা মৎস্য খটি)
- সম্পাদক: লক্ষ্মী নারায়ণ জানা
- সহ-সভাপতি: অজয় বর
- সহ-সম্পাদক: শেখ নজরুল
- কোষাধ্যক্ষ: দেবব্রত মণ্ডল
- অন্যান্য সদস্য: বীরেন জানা সহ মোট ১৩ জন, যার মধ্যে পাঁচজন মহিলা।
নতুন কমিটি দাবি করেছে, তারা মৎস্যজীবীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করবে এবং সরকারি প্রকল্পগুলি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করবে। তবে, আমিন সোহেলের অভিযোগের কারণে এই কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
আমিন সোহেল জানিয়েছেন, তিনি মৎস্যজীবীদের সংগঠিত করে এই অবৈধ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন। তিনি মৎস্য দপ্তরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমরা চাই মৎস্যজীবীদের স্বার্থ সুরক্ষিত হোক। এই সমিতি তাদের জন্য কাজ করবে, কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের স্বার্থে নয়।”
সাধারণ মৎস্যজীবীদের উদ্বেগ
কাঁথির মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। অনেকে মনে করছেন, এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সমিতির মূল উদ্দেশ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সাধারণ মৎস্যজীবীরা চান, তাদের সংগঠন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হোক, যাতে সরকারি সুবিধাগুলি তাদের কাছে পৌঁছায়। এই দ্বন্দ্বের সমাধান না হলে মৎস্যজীবীদের মধ্যে অসন্তোষ আরও বাড়তে পারে।
কাঁথি মহকুমা খটি মৎস্যজীবী উন্নয়ন সমিতির সভাপতি পরিবর্তন নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব এই সংগঠনের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে প্রকাশ্যে এনেছে। আমিন সোহেলের নেতৃত্বে মৎস্যজীবীরা এই অবৈধ মিটিংয়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছেন। এই পরিস্থিতি কীভাবে সমাধান হবে এবং সমিতির ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে সাধারণ মৎস্যজীবীদের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। আগামী দিনে এই বিষয়ে মৎস্য দপ্তরের হস্তক্ষেপ এবং সঠিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধানের প্রত্যাশা করছেন সকলে।