চম্পাহাটি স্টেশন থেকে বেরিয়ে ডান দিকে সোজা রাস্তা। অপেক্ষা করছিলেন রূপক চৌধুরী (Rupak Chowdhury)। কলকাতা ময়দান রূপক চৌধুরীর নাম এখনও ভোলেনি। তাঁর ভক্তরা এখনও ছড়িয়ে রয়েছেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। জিএসটিতে চাকরি করছেন। আর মাস পনেরো পর রিটায়ারমেন্ট। তাঁকে দেখে বোঝার উপায় নেই তাঁর অবসর নেওয়ার বয়স হয়েছে। ছিপছিপে শরীরে বার্ধক্য এখনও সেভাবে ছাপ ফেলতে পারেনি।
এই বয়সে এসে অনেকেই নিজেকে সরিয়ে নেন কাজের জগৎ থেকে। রূপক অন্যরকম। নিজের স্বপ্ন নিয়ে এখন লড়াই চালাচ্ছেন। ১৯৯৩ সাল থেকে দু’চোখে যে স্বপ্ন নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিলেন তার অনেকটা পূর্ণ করেছেন, অনেকটা বাকি রয়েছে। রূপক চৌধুরী যে স্বপ্ন দেখেছেন তা কখনও শেষ হওয়ার নয়। দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা শিখিয়ে মানুষ করার কাজে রত রয়েছেন বছরের পর বছর ধরে। নিঃশব্দে। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০২৪, মাঝে এতগুলো দিন, ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড। অথচ রূপক চৌধুরীর হরিনাভি সৃজনের কথা ক’জন জানেন সেভাবে? ইন্টারনেট খুঁজলে গুটি কতক লেখা। তাও পুরনো। রূপক “পাবলিসিটি” চান না। লোকের মুখে ছড়িয়ে পড়ুক, যাদের ইচ্ছা হবে তাঁরা পাশে এসে দাঁড়াক, এটাই তাঁর বক্তব্য।
চম্পাহাটি স্টেশন থেকে চিনার মোড়, বাঁ-দিকের রাস্তা ধরে গেলে হাড়াল। রূপক চৌধুরীর তৈরি করা স্কুল। সেখানে এখন পড়াশুনা করে সব মিলিয়ে ১২৪ জন খুদে ছেলে-মেয়ে। এমনিতে চম্পাহাটি বাজি তৈরি করার জন্য পরিচিত। মূলত বাজি তৈরি কারিগরদের সন্তানরা আসেন ‘সৃজন বিদ্যাপীঠ’-এ।
“ও কাকু, ও কাকু…”, রূপক স্কুলে প্রবেশ করার পরেই ছুটে আসে বাচ্চারা। নতুন ড্রেস পরানো হচ্ছিল সেদিন। রূপক নিজে হাতে ঠিক করে দিলেন কচিকাঁচাদের স্কুল ইউনিফর্ম।
রূপক চৌধুরী জানিয়েছেন, “স্কুলের আশেপাশে আগে পাকা ঘর-বাড়ি ছিল না। ইলেকট্রিক লাইন ছিল না। এখানে এসে গ্রামবাসীদের বোঝাতে হয়েছে বাচ্চাদের জন্য শিক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। সেই বাধা কেটেও গিয়েছে… আমি কখনও বৈভব চাইনি। দরকারের থেকে বেশি পেয়ে গেলে মানুষের মন ঘুরে যেতে পারে। তখন মূল লক্ষ্য থেকে সরে যায় মানুষ। যখন যেমন পেরেছি করেছি। আমার পরিবার, অফিসের পরিচিতরা সব সময় পাশে থেকেছেন। আমার খেলার ভক্ত ছিলেন এমন লোককেও পাশে পেয়েছি। আমাদের কাজের খবর শুনে এখনও অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।”
২০০৫ সালে হরিনাভি সৃজন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ২০০৬ সালে হরিনাভি সৃজন চম্পাহাটির হাড়ালে প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরি করার কাজ শুরু হয়। মানবাধিকার কর্মী রেভারেন্ড জেসি জ্যাকসনের উপস্থিতিতে শুরু হয়েছিল এই পথ চলা। পরবর্তী বছরগুলোতে ২০২০ সালে বাড়িয়া, বাসন্তী, চুনাখালীতে অতিরিক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করে রৌপক চৌধুরী তাঁর স্বপ্নের পরিসর বৃদ্ধি করেছেন। এখন সুন্দরবনের সোনাগায় স্কুল তৈরি করার কাজ করছেন। ভবিষ্যত পরিকল্পনা – বৃদ্ধাশ্রম বা HIV আক্রান্ত শিশুদের হোম বানানো
রূপক চৌধুরীর ছেলে ডাক্তারি পড়ছেন। ইচ্ছে, ভবিষ্যতে ছেলেও তাঁর কাজের মাধ্যমে এই সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হবেন।