ম্যাঞ্চেস্টারের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে চলমান ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে ঋষভ পন্থ (Rishabh Pant) তাঁর অসাধারণ ব্যাটিং দক্ষতা এবং অদম্য মনোবল দিয়ে আবারও সমর্থকদের হৃদয় জয় করেছেন। বৃহস্পতিবার, ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে পায়ের আঙুলে চোট নিয়েও মাঠে নেমে তিনি ভারতের কিংবদন্তি ক্রিকেটার বীরেন্দ্র সেহওয়াগের টেস্ট ক্রিকেটে সর্বাধিক ছক্কার রেকর্ডের সমান করেছেন। উভয়ের নামে এখন টেস্ট ক্রিকেটে ৯০টি করে ছক্কা রয়েছে। এই মাইলফলক অর্জনের পাশাপাশি পন্থ ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মাকে ছাড়িয়ে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ (ডব্লিউটিসি) যুগে ভারতের শীর্ষ রান সংগ্রাহক হয়েছেন। তবে, পন্থের এই ব্যক্তিগত সাফল্য সত্ত্বেও ভারতীয় দল দ্বিতীয় দিন শেষে পিছিয়ে পড়েছে, কারণ ইংল্যান্ড তাদের ‘বাজবল’ ধরণের খেলায় দাপট দেখিয়েছে।
পন্থের রেকর্ড গড়া যাত্রা
ম্যাচের প্রথম দিনে, ইংল্যান্ডের পেসার ক্রিস ওকসের একটি টো-ক্রাশিং ইয়র্কারে পন্থের ডান পায়ের আঙুলে আঘাত লাগে। তিনি তখন ৩৭ রানে ব্যাট করছিলেন এবং প্রচণ্ড ব্যথায় মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। গলফ কার্টে করে তাঁকে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং হাসপাতালে স্ক্যান করা হয়। স্ক্যান রিপোর্টে নিশ্চিত হয় যে তাঁর পায়ের হাড়ে চিড় ধরেছে, যার ফলে তিনি এই ম্যাচে আর উইকেটকিপিং করতে পারবেন না। তবে বিসিসিআই জানিয়েছে, প্রয়োজনে পন্থ ব্যাটিং করতে পারবেন।
দ্বিতীয় দিনে, চোট নিয়েও পন্থ সাহসিকতার সঙ্গে মাঠে ফিরে আসেন এবং ৭৫ বলে ৫৪ রানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন। তাঁর এই ইনিংসে ছিল তিনটি চার এবং দুটি ছক্কা। এই ইনিংসের ১১০তম ওভারে জোফ্রা আর্চারের বলে মিড-উইকেটের উপর দিয়ে একটি বিশাল ছক্কা মেরে তিনি সেহওয়াগের ৯০ ছক্কার রেকর্ডে সমান হন। এই মাইলফলক তাঁর ক্যারিয়ারে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় যোগ করেছে, বিশেষ করে যখন বিবেচনা করা হয় যে সেহওয়াগ ১০৪ টেস্টে এই রেকর্ড গড়েছিলেন, আর পন্থ মাত্র ৪৬ টেস্টে এই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
এছাড়াও, পন্থ রোহিত শর্মাকে ছাড়িয়ে ডব্লিউটিসি-র ইতিহাসে ভারতের শীর্ষ রান সংগ্রাহক হয়েছেন। তিনি ৩৮টি টেস্ট ম্যাচে ২৭৩১ রান করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ছয়টি সেঞ্চুরি এবং ষোলটি হাফসেঞ্চুরি। রোহিতের রান ২৭১৯। পন্থের এই অর্জন তাঁর অসাধারণ ধারাবাহিকতা এবং আক্রমণাত্মক ব্যাটিং শৈলীর প্রমাণ। তিনি এই সিরিজে ইতিমধ্যে ৪২৫ রান করেছেন, গড় ৭০.৮৩, যার মধ্যে রয়েছে দুটি সেঞ্চুরি এবং দুটি হাফসেঞ্চুরি।
চোটের মধ্যেও পন্থের সাহসিকতা
পন্থের এই পারফরম্যান্স তাঁর অদম্য মানসিক শক্তি এবং দেশের জন্য খেলার প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। প্রথম দিনে চোট পাওয়ার পর তাঁর মাঠে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। তবে, তিনি দ্বিতীয় দিনে ব্যাট হাতে ফিরে এসে দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রান যোগ করেন। তাঁর ৫৪ রানের ইনিংস ভারতের মোট ৩৫৮ রানে পৌঁছাতে সহায়ক ছিল। এই ইনিংসে তিনি শুধু রেকর্ডই গড়েননি, বরং দলের মনোবলও বাড়িয়েছেন। সচিন তেন্ডুলকরও তাঁর এই প্রচেষ্টার প্রশংসা করে এক্স-এ লিখেছেন, “ঋষভ পন্থের এই পঞ্চাশ রান দেশের জন্য খেলার জন্য প্রয়োজনীয় দৃঢ়তা ও প্রতিশ্রুতির একটি শক্তিশালী প্রমাণ।”
পন্থ এই সিরিজে ভারতীয় উইকেটকিপারদের মধ্যে একটি টেস্ট সিরিজে সর্বাধিক ৫০+ স্কোরের রেকর্ডও গড়েছেন। তাঁর এই সিরিজে পাঁচটি ৫০+ স্কোর রয়েছে, যা ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার (১৯৭২/৭৩) এবং এমএস ধোনির (২০০৮/০৯ এবং ২০১৪) পূর্ববর্তী রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।
ভারতের দিনের শেষে পিছিয়ে পড়া
পন্থের ব্যক্তিগত সাফল্য সত্ত্বেও, ভারত দ্বিতীয় দিন শেষে ব্যাকফুটে রয়েছে। ইংল্যান্ড তাদের প্রথম ইনিংসে ২২৫/২-এ পৌঁছে গেছে, যেখানে ওপেনার বেন ডাকেট (১০০ বলে ৯৪) এবং জাক ক্রলি (১১৩ বলে ৮৪) ১৬৬ রানের একটি দ্রুতগতির জুটি গড়েন। দিনের শেষে অলি পোপ (২০) এবং জো রুট (১১) অপরাজিত ছিলেন। ইংল্যান্ড ভারতের প্রথম ইনিংসের ৩৫৮ রানের তুলনায় মাত্র ১৩৩ রানে পিছিয়ে রয়েছে।
ইংল্যান্ডের ‘বাজবল’ ধরণের খেলা ভারতীয় বোলারদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ভারতের বোলিং আক্রমণ এই ম্যাচে এখনও পর্যন্ত উইকেট তুলতে সংগ্রাম করছে, এবং পন্থের অনুপস্থিতিতে উইকেটকিপিংয়ের দায়িত্ব পালন করছেন ধ্রুব জুরেল। তবে, পন্থের চোটের কারণে তাঁর এই সিরিজের বাকি ম্যাচে অংশগ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। বিসিসিআই জানিয়েছে, তাঁর পুনর্বাসন জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির মেডিক্যাল টিমের তত্ত্বাবধানে হবে।
পন্থের বদলি হিসেবে কে?
পন্থের চোটের কারণে তাঁর সিরিজের বাকি ম্যাচে খেলা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সূত্রের খবর, তাঁর বদলি হিসেবে ঈশান কিষাণকে দলে ডাকা হচ্ছে। ঈশান সম্প্রতি ভারত এ দলের হয়ে ইংল্যান্ডে খেলেছেন এবং তাঁর টেস্ট দলে ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, কিছু সূত্রে দাবি করা হয়েছে যে ঈশান সম্প্রতি একটি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন, তাই তাঁর বদলি হিসেবে তামিলনাড়ুর উইকেটকিপার-ব্যাটার এন জগদীশনের নামও উঠে আসছে। বিসিসিআই-এর পক্ষ থেকে এখনও কোনও সরকারি ঘোষণা আসেনি।
ঋষভ পন্থের এই ম্যাচে প্রদর্শিত সাহসিকতা এবং রেকর্ড তাঁকে ভারতীয় ক্রিকেটের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে, ভারতীয় দলের জন্য এই ম্যাচে পিছিয়ে পড়া এবং পন্থের চোট নিয়ে উদ্বেগ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী দিনে দল কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেয় এবং পন্থের পুনর্বাসন কতটা দ্রুত হয়, সেটাই এখন দেখার।