কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ফুটবল ক্লাব মহামেডান স্পোর্টিং-এর (Mohammedan SC ) ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চয়তার মুখে। ভারতীয় ফুটবলের শীর্ষ স্তরের প্রতিযোগিতা ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল)-এ অংশগ্রহণের জন্য আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় ক্লাবটির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের হুমকি দিয়েছে আইএসএল-এর প্রোমোটার ফুটবল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (এফএসডিএল)। গত ৪ এপ্রিল তারিখে এফএসডিএল ক্লাবটিকে একটি নোটিস জারি করে, যাতে আর্থিক দায়বদ্ধতা পূরণে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের দাবি জানানো হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যাংক গ্যারান্টি জমা না দিলে এবং শেয়ার সাবস্ক্রিপশন ও শেয়ারহোল্ডার চুক্তি (এসএসএসএইচএ) কার্যকর না করলে ক্লাবটির আইএসএল-এ অংশগ্রহণ বাতিল হতে পারে।
গত মরসুমে আই-লিগ জিতে আইএসএল-এ প্রোমোশন পাওয়ার পর মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্রাইভেট লিমিটেড (এমএসসিপিএল) ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির মাধ্যমে শ্রাচি স্পোর্টসকে প্রধান বিনিয়োগকারী হিসেবে এবং পূর্ব থেকে থাকা বিনিয়োগকারী বাঙ্কারহিল প্রাইভেট লিমিটেড (বিপিএল)-এর সঙ্গে মিলে একটি ত্রিপক্ষীয় কনসোর্টিয়াম গঠন করা হয়। শেয়ার বণ্টনের হার নির্ধারণ করা হয় যথাক্রমে ৩৯%, ৩০.৫%, এবং ৩০.৫%। কিন্তু আইএসএল-এ তাদের প্রথম মরসুমেই ক্লাবটি মাঠের ভিতরে ও বাইরে চরম সংকটের মধ্যে পড়ে। ১৩ দলের মধ্যে ২৪ ম্যাচে মাত্র ১৩ পয়েন্ট নিয়ে তারা তালিকার তলানিতে শেষ করে।
আর্থিক ও ক্রীড়াগত সংকট
মহামেডান স্পোর্টিং-এর এই মরসুম ছিল একের পর এক বিপর্যয়ে ভরা। খেলোয়াড়রা প্রায়ই তিন-চার মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে অনুশীলন বয়কট করেছেন। এমনকি প্রধান কোচ আন্দ্রে চের্নিশভও মাঝপথে ক্লাব ছেড়ে চলে যান, কারণ তাঁর বেতনও পরিশোধ করা হয়নি। মাঠে তাদের পারফরম্যান্সও ছিল হতাশাজনক—২৪টি ম্যাচে মাত্র ২টি জয় এবং ১৫টি হার। এই পরিস্থিতিতে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার্স’ নামে পরিচিত এই ক্লাবটির সমর্থকদের মনোবল ভেঙে পড়েছে।
এরই মধ্যে শ্রাচি স্পোর্টস ২ এপ্রিল এফএসডিএল-কে জানিয়েছে যে, তারা ক্লাবের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করেছে। ২০২৪-২৫ মরসুমের জন্য প্রায় ৩০-৩৫ কোটি টাকার বাজেটের অর্ধেক অর্থায়ন করা সত্ত্বেও তারা এখন আর কোনও দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। শ্রাচি স্পোর্টস জানিয়েছে, “আমাদের এমওইউ গত ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪-এ মেয়াদ শেষ হয়েছে। এমএসসিপিএল এবং বিপিএল-এর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা এবং একাধিক দফা বৈঠকের পরও লেনদেন সম্পন্ন করার কোনও সম্ভাবনা দেখা যায়নি। আমরা এখনও এমএসসিপিএল-এর শেয়ারহোল্ডার নই। আমাদের দেওয়া অর্থকে এখন আন্তঃকোম্পানি ঋণ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, যা এমএসসিপিএল-কে ফেরত দিতে হবে।”
এফএসডিএল-এর কঠোর অবস্থান
শ্রাচির এই চিঠি পাওয়ার পর এফএসডিএল তৎক্ষণাত পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা ক্লাবকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, আইএসএল-এ অংশগ্রহণের জন্য আর্থিক স্থিতিশীলতা একটি মৌলিক শর্ত। এফএসডিএল-এর চিঠিতে বলা হয়েছে, “আমরা আপনার সঙ্গে পূর্ববর্তী চিঠিপত্রের উল্লেখ করছি, যেখানে আপনি অংশগ্রহণ চুক্তি অনুযায়ী ব্যাংক গ্যারান্টি জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এসএসএসএইচএ কার্যকরে বিলম্ব করেছেন। আমাদের ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এর চিঠি এবং আপনার ৩ মার্চ ২০২৫-এর জবাবের কথা উল্লেখযোগ্য। আপনি বারবার আশ্বাস দিয়েছেন যে, শ্রাচি স্পোর্টস ৩১ মে ২০২৫-এর মধ্যে প্রধান বিনিয়োগকারী হিসেবে যোগ দেবে। এই আশ্বাসের ওপর ভরসা করে আমরা আপনাকে সময় দিয়েছি এবং কোনও পদক্ষেপ না নিয়ে আইএসএল-এ আপনার অংশগ্রহণ অব্যাহত রেখেছি।”
এফএসডিএল আরও জানিয়েছে, “এটা উদ্বেগজনক যে, আইএসএল-এর সক্রিয় খেলার পর্বে মহামেডান শ্রাচি স্পোর্টসের সঙ্গে চলমান সমস্যার কথা প্রকাশ করেনি। প্লে-অফে উঠতে ব্যর্থ হওয়ার পরই এই তথ্য সামনে এসেছে। স্বচ্ছতা এবং সময়মতো তথ্য প্রকাশের অভাবে আমাদের প্রশ্ন উঠছে, এই তথ্য কি ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন রাখা হয়েছিল?”
বহিষ্কারের হুমকি
আইএসএল-এর নিয়ম অনুযায়ী, মহামেডানকে ৩০ দিনের মধ্যে নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজে বের করতে হবে এবং ১১ এপ্রিলের মধ্যে বকেয়া পাওনা—খেলোয়াড়, কারিগরি স্টাফ এবং বিক্রেতাদের—সম্পর্কে বিস্তারিত হিসাব দিতে হবে। এফএসডিএল স্পষ্ট করে বলেছে, “এই দাবি পূরণে ব্যর্থ হলে আমাদের আর কোনও উপায় থাকবে না। অংশগ্রহণ চুক্তি অনুযায়ী আপনার আইএসএল-এ অংশগ্রহণ বাতিল করা ছাড়া আমাদের আর কোনও বিকল্প থাকবে না।”
ক্লাবের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ
মহামেডান স্পোর্টিং এখনও এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে নিউজ৯ স্পোর্টস-এর খবর অনুযায়ী, তারা নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজছে এবং আসন্ন সুপার কাপে অংশ নেওয়ার আশা করছে। এই সংকটের মধ্যেও ক্লাবটির সমর্থকরা আশা ছাড়ছেন না। তবে এই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি আইএসএল-এ টিকে থাকতে পারবে কি না, তা এখন সময়ের ওপর নির্ভর করছে।
কলকাতার ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে এই ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। মহামেডান স্পোর্টিং-এর মতো একটি শতাব্দী প্রাচীন ক্লাবের এমন দুরবস্থা দেখে অনেকেই হতাশ। আগামী দিনে ক্লাবটি কীভাবে এই সংকট কাটিয়ে ওঠে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।