ভারত-পাক চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীতার আবহে ভারতীয় ফুটবলের সোনালি অতীত

বিদেশের মাটিতে ভারতের জাতীয় ফুটবল (Football) দলের প্রথম জয়। একটুও নাক কুঁচকাবেন না। সালটা ১৯৬২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আজকের দিনেই ভারত ৬০ বছর আগে ঐতিহাসিক…

India's national football team's first win on foreign soil

বিদেশের মাটিতে ভারতের জাতীয় ফুটবল (Football) দলের প্রথম জয়। একটুও নাক কুঁচকাবেন না। সালটা ১৯৬২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আজকের দিনেই ভারত ৬০ বছর আগে ঐতিহাসিক মাইলস্টোন স্পর্শ করেছিল।

১৯৬২ সালের এশিয়ান গেমসে প্রদীপ কুমার ব্যানার্জী (পিকে ব্যানার্জী) এবং জার্নেল সিং’র গোলে ভারত দক্ষিণ কোরিয়াকে ২-১ গোলের ব্যবধানে পরাজিত করে, সোনার পদক পেয়েছিল। এখনও পর্যন্ত এই জয়কেই আন্তর্জাতিক ফুটবলে ভারতের সবচেয়ে বড় জয় হিসেবে দেখা হয়।

   

অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে ভারতীয় ফুটবল দল জার্কাতায় যাওয়ার জন্য বিমান ধরেছিল। ১৪ বছর হয়েছিল ভারত স্বাধীন হয়েছে। ভারতের সরকারি কোষাগারে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে ভারতের ফুটবল দলের অংশগ্রহণ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়! কিন্তু প্রবীণ কংগ্রেস নেতা এবং বঙ্গ ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা আইএফএ সভাপতি অতুল্য ঘোষ বিষয়টিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং অর্থমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের কাছে তুলে ধরেন এবং অবশেষে, ভারতের জাতীয় ফুটবল দল জাকার্তার উদ্দ্যেশে বিমানে ওঠে।

এশিয়ান গেমসের ‘বি’ গ্রুপের প্রথম ম্যাচে কোরিয়ার কাছে হেরে যায় ভারত। ১৯৬২ সালের এশিয়ান গেমসের প্রথম ম্যাচেই হারের মুখ দেখা ভারতীয় দলে প্রধান কোচ সৈয়দ আবদুল রহিম পরের খেলায় কিছু পরিবর্তন করেছিলেন এবং এই পরিবর্তনের জন্য গেমসে ভারতকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

এশিয়ান গেমসের সেমিফাইনালে ভারত দক্ষিণ ভিয়েতনামকে হারিয়ে ছিল। ওই সময় দক্ষিণ ভিয়েতনাম দলের লাইন আপে বেশ কয়েকজন ফরাসি খেলোয়াড় ছিল। থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে গ্রুপ লিগের ম্যাচে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার জার্নেল সিং আহত হন এবং তার মাথায় ভারী ব্যান্ডেজ করা হয়। কিন্তু তিনি ভারতের পরিকল্পনায় অপরিহার্য থাকায় সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে তাকে সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলানো হয় এবং এই দুই ম্যাচেই একটি করে গোল করেন,জার্নেল সিং।

১৯৬২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায়, জাকার্তার সেনায়ান প্রধান স্টেডিয়াম কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের জন্য প্রায় ১,০০,০০০ শক্তিশালী ইন্দোনেশিয়ান দর্শকে ভরে গিয়েছিল। তবে স্ট্যান্ডে ভারতীয়দের সমর্থনও ছিল। আর এখানেই চমকপ্রদ এক ঘটনা ঘটে যা ইতিহাসের পাতা উল্টোলে চোখ ছানাবড়া হতে বাধ্য। যদিও পাকিস্তান ১৯৬২ সালের আগেই ১৯৪৭ সালে আচমকা ভারতের কাশ্মীর উপত্যকায় সেনা অভিযানে ‘জন্নতের’ একাংশ দখল করে নিয়ে অধিকৃত কাশ্মীরকে ‘আজাদ কাশ্মীর’ বলে ঘোষণা করে এবং পাক সেনাবাহিনী হানাদারদের বেশে পুরো কাশ্মীর দখলের জন্য এগোতে থাকে। কোনও উপায় না দেখে কাশ্মীরের হিন্দু রাজা হরি সিং ভারতে সংযুক্তিকরণের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে, সংযুক্তিকরণের বদলে জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার আশ্বাসে। যদিও এই

সংযুক্তিকরণের ইস্যুতে তৎকালীন কেন্দ্রীয় রাজন্যবর্গ তথা দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মাস্টারস্ট্রোক ছিল তখনকার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS) প্রধান মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকরকে প্যাটেল কাশ্মীরের রাজা হরি সিং’র কাছে ভারত সরকারের ‘দূত’ হিসেবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত। অবশ্য ভারতের তৎকালীন

প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সর্দার প্যাটেলের RSS প্রধান গোলওয়ালকরকে ভারত সরকারের দূত হিসেবে পাঠানো নিয়ে আপত্তি ছিল।কিন্তু পরিবেশ আর পরিস্থিতির চাপে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু গোলওয়ালকরকে ভারত সরকারের দূত হিসেবে পাঠানোর ইস্যুতে অপ্রিয়কর সিদ্ধান্তে আসতে ‘বাধ্য হন’।

জাকার্তার সেনায়ান প্রধান স্টেডিয়ামে পারস্পরিক সংঘাতের আবহে শুনতে অদ্ভুত লাগলেও বাস্তবকে অস্বীকার না করে বলতেই হয় ওইদিন অর্থাৎ ১৯৬২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান হকি দল ভারতের হয়ে উল্লাস করেছিল কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ম্যাচে।

প্রখ্যাত প্রবাদপ্রতিম ভারতীয় কোচ ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর পিকে ব্যানার্জীর ‘ভোকাল টনিক’ স্টেডিয়ামে ওই মুহুর্তে কাজে এসেছিল যখন কোরিয়া দলের হয়ে ইন্দোনেশীয়ান দর্শক গলা ফাটাচ্ছে, এমন প্রতিকূল পরিবেশ ব্লু টাইগারদের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল পাকিস্তান হকি দলের সমর্থন স্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে ভারতীয় ফুটবল দলকে উদ্দেশ্য করে। ১৭তম মিনিটে পিকে ব্যানার্জী ভারতকে লিড এনে দেন, তার আগে কপালে চারটি সেলাই নিয়ে খেলতে থাকা জার্নেল র্সিং তিন মিনিট পর গোলের স্কোরলাইন ২-০ করেন।

ভারতীয় ডিফেন্ডার অরুণ ঘোষ ওই ম্যাচের স্মৃতি চারণাতে বলেন,”আমরা যখন ২-০ এগিয়ে গিয়েছিলাম তখন স্টেডিয়ামে পিন-ড্রপ নীরবতা ছিল।” অর্জুন পুরস্কারপ্রাপ্ত জাতীয় দলের প্রাক্তন ফুটবলার অরুণ ঘোষের কথায়,”যদিও কোরিয়া রিপাবলিক দেরিতে গোল করেছিল, ভারতীয় গোলরক্ষক পিটার থঙ্গারাজ শেষ পর্যন্ত বিপক্ষের বিপদ নিয়ে সতর্ক ছিলেন। ভারতীয় দলটির বিরুদ্ধে শত্রুতা এতটাই বেশি ছিল যে ম্যাচের পরে খুব কমই কেউ আমাদের অভিনন্দন জানাতে এসেছিল।” ওই ম্যাচ নিয়ে অরুণ ঘোষ আরও জানান,”যখন আমরা ডিফেন্ডার হিসেবে খেলতে শুরু করি, তখন আমাদের লক্ষ্য ছিল প্রাথমিকভাবে বল ক্লিয়ার করা এবং বিপদ এড়ানো। কিন্তু রহিম-সাব ধারণা পাল্টে দিয়েছেন।”

এশিয়ান গেমসে ভারতীয় ফুটবল দলের হেডকোচ প্রয়াত সৈয়দ আব্দুল রহিমের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় প্রাক্তন ভারতীয় ডিফেন্ডার অরুণ ঘোষ বলেন,”রহিম-সাব আমাদের শিখিয়েছেন যে আক্রমণ শুরু হয় গোলরক্ষক থেকে। তিনি আমাদের গ্রাউন্ড-পাসিং এবং ব্যক্তিগতভাবে খেলাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সূক্ষ্মতা শিখিয়েছিলেন। পুরো ভ্যান্টেজ পয়েন্ট পরিবর্তন করা হয়েছিল এবং শীঘ্রই ফলাফলগুলি অত্যন্ত ইতিবাচক ছিল।” ইতিহাসের পাতা ঘাটলে ভারতীয় ফুটবল আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিদ্বন্দ্বীতার এমন রেকর্ড শুধু ঈর্ষণীয় বললেও কম বলা হবে। ফিফা নির্বাসনের খাঁড়া কাঁধের থেকে নামিয়ে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন পুনরায় ভারতীয় ফুটবলকে উচ্চতার শিখরে নিয়ে যাবে নবনির্বাচিত ফেডারেশন সভাপতি কল্যাণ চৌবের কথা আর কাজের মধ্যে মিল কতটা চোখে আসে তা সময়ের অপেক্ষা।