ইউরোপের ঠান্ডা থেকে বাগানের তপ্ত রোদেও সাফল্যের রসায়ন ফাঁস করলেন কাউকো

গত আইএসএলে সবচেয়ে কার্যকরী ফুটবলারের তালিকা তৈরি করলে খুব ওপরের দিকেই থাকবে জনি কাউকোর (Joni Kauko) নাম। সবার ওপরে রাখলেও হয়তো বিশেষ ভুল হবে না।…

Joni Kauko

গত আইএসএলে সবচেয়ে কার্যকরী ফুটবলারের তালিকা তৈরি করলে খুব ওপরের দিকেই থাকবে জনি কাউকোর (Joni Kauko) নাম। সবার ওপরে রাখলেও হয়তো বিশেষ ভুল হবে না। দক্ষ সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসাবে দারুণ সফল ৩০ বছর বয়সি এই কাউকো। ফিনল্যান্ডের হয়ে এই পজিশনেই গত বছর ইউরো কাপে তিনটি ম্যাচে খেলেছেন।

তবে শুধু এই জায়গায় নয়, দলের প্রয়োজনে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের ভূমিকাও পালন করতে পারেন তিনি। তাঁর এই বৈশিষ্টের জন্য মাঝমাঠ ও আক্রমণের মধ্যে সেতু হিসেবে কাউকোকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন এটিকে মোহনবাগানের প্রাক্তন স্প্যানিশ কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। বর্তমান কোচ জুয়ান ফোরান্দোও তাঁকে প্রায় একই ভূমিকা পালন করতে দিয়েছেন। আর তাতে সাফল্যের চূড়ায় কাউকো।

কয়েক দিন আগেই কলকাতায় তাঁকে সাংবাদিক বৈঠকে বলতে শোনা যায়, “ভারতে এসে প্রথম দশটি ম্যাচে আমি কিছুটা রক্ষণাত্মক ভূমিকায় ছিলাম। সেটাই আমার কাছে নতুন ছিল। দলকে সাহায্য করার জন্য আমি সব সময় নিজের সেরাটা দিতে চাই। কিন্তু একটু উঠে খেললেই নিজের সেরাটা দিতে পারি আমি। তবে আমার মনে হত, নীচে নেমে খেললে নিজের সেরাটা দিতে পারছি না। যত উঠে খেলতে শুরু করি, তত স্বাচ্ছন্দবোধ করি। এখন পর্যন্ত এটিকে মোহনবাগানের হয়ে খেলাটা আমার কাছে খুব ভাল অভিজ্ঞতা। সময়টা উপভোগ করছি। এরকম ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার জন্যই এখানে এসেছি আমি।’’

গত বছর ইউরো কাপে ফিনল্যান্ডের হয়ে ইউরো কাপে খেলেন কাউকো। এমন একজন ফুটবলারকে এনে হইচই ফেলে দেয় এটিকে মোহনবাগান। এই প্রথম সদ্য ইউরো ফেরত কোনও ফুটবলার এক ভারতীয় ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। তাই তাঁকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন এটিকে মোহনবাগান সমর্থকেরা। যদিও এএফসি কাপের ম্যাচে কাউকোকে দেখে হতাশ হন অনেকেই। সেই প্রসঙ্গে ফিনল্যান্ডের ফুটবলার বলেছিলেন, “প্রথম ম্যাচে যে রকম ফল হবে বলে মনে করেছিলাম, সে রকম হয়নি। আমি নিজেও আরও ভাল খেলব বলে ভেবেছিলাম, কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। তবু বলব, দলকে ভাল ভাবে জানার জন্য ওই ম্যাচটা খুব প্রয়োজন ছিল”।

কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে তেমন কার্যকরী না হয়ে উঠতে পারলেও এসসি ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে নিজেকে প্রমাণ করেন তিনি। লাল-হলুদ রক্ষণে চিড় ধরাতে তাঁর ভূমিকা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিন গোলের জয়ে একটি গোলে তাঁর প্রত্যক্ষ মদতও ছিল, যা দেখার পরে কাউকোকে নিয়ে আশাবাদী হয়ে ওঠেন সমর্থকেরা। হাবাস তাঁকে নিয়মিত প্রথম দলে রাখলেও কাউকোর পছন্দের জায়গায় ব্যবহার করেননি। যেটা ফেরান্দো এসে করেন এবং আরও বেশি কার্যকরী হয়ে ওঠেন তিনি।

যে সময়ে দল চোট-আঘাত ও করোনায় জর্জরিত, ফেরান্দো প্রথম এগারোয় নিজের পছন্দমতো চার বিদেশিকে রাখতে পারা তো দূরের কথা, পছন্দের এগারোও নামাতে পারছিলেন না, সেই সময়ে কাউকোই দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সদস্য হয়ে ওঠেন। এটিকে মোহনবাগান যে টানা ১৫টি ম্যাচে অপরাজিত ছিল, তাতে কাউকোর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে তিনি তিনটি গোল করেন ও করান ফিনল্যান্ডের তারকা। গড়ে প্রতি ম্যাচে ৩১টি করে পাস খেলেন তিনি, যার মধ্যে ৮০.২২ শতাংশ ছিল নিখুঁত। ছ’টি গোল করিয়ে সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টের তালিকায় তিনি ছিলেন পাঁচ নম্বরে।

আসলে শারীরিক সক্ষমতা এবং সুঠাম ও দীর্ঘ শরীরের অধিকারী হওয়ায় প্রতিপক্ষের দীর্ঘদেহী ডিফেন্ডারদের মোকাবিলা করতে সুবিধা হয় তাঁর। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে এটা তাঁর একটা বড় সুবিধা। ফলে বুমৌসের মতো স্কিল বা রয় কৃষ্ণার মতো শট নেওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও শুধু নিখুঁত পাসিং ও কার্যকরী উপস্থিতি দিয়ে বাজিমাত করে দিতে পারেন কাউকো।

শুধু আইএসএল নয়, এটিকে মোহনবাগানের পরবর্তী অ্যাসাইনমেন্ট এএফসি কাপেও উজ্জ্বল ছিলেন তিনি। প্রাথমিক পর্বে শ্রীলঙ্কার ব্লু স্টারের বিরুদ্ধে জোড়া গোল করেন এবং গ্রুপ পর্বে বসুন্ধরা কিংস ও মাজিয়া এসআরের বিরুদ্ধে দু’টি গোল করার করেন। এ বার তাঁর সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ, এএফসি কাপের ইন্টার জোনাল সেমিফাইনাল, যে ম্যাচে সবুজ-মেরুন জার্সিতে প্রথম খেলে গত বছর খুব খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। ছ’গোলে সেই ম্যাচে হেরেছিল তারা।

ফিনল্যান্ডের ইন্টার তুর্কুতে পেশাদার ফুটবলজীবন শুরু করা কাউকো ২০০৮-এ তাদের দেশের ঘরোয়া লিগ কাপ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন। তাদের যুব দলে তিন বছর খেলার পরে সে বছরই প্রথম সিনিয়র দলের হয়ে আটটি ম্যাচ খেলেন তিনি এবং আসে সাফল্য। দলকে আরও দু’টি ট্রফি দিয়ে ইন্টারের শত্রুশিবির এফসি লাহিতিতে যোগ দেন কাউকো। ফুটবলজীবনে দারুন কিছু করেননি ঠিকই। কিন্তু ইউরোপের ফুটবলে নিজের ঔজ্জ্বল্য বজায় রাখার জন্য যা যা করার তার সবই করেছেন। ড্যানিশ সুপারলিগার ক্লাব রান্ডার্স ও এজবার্গের হয়ে খেলেছেন। জার্মানির এফএসভি ফ্র্যাঙ্কফুর্ট এবং এফসি এনার্জি কটবাসের জার্সি গায়েও মাঠে নেমেছেন। শেষে জাতীয় দলের হয়েও ইউরোয় খেলেন। এর পরে বিশ্ব দর্শনের ইচ্ছা হয় তাঁর।

এমন একটা পরিবেশ থেকে ভারতে এসে মানিয়ে নেওয়া সোজা ছিল না একেবারেই। এই প্রথম ইউরোপের বাইরে কোনও দেশে পা রাখেন ফুটবলের জন্য। এখানকার গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে যে প্রথম প্রথম বেশ কষ্টই হয় তাঁর, আইএসএলে খেলতে এসে তা স্বীকার করে নেন। অগাস্টে ভারতে আসার পরে এক সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, “এখানে এসে প্রথম অনুশীলনের পর আমি একটু চিন্তিত হয়ে পড়ি ঠিকই। কারণ, আমার মতো উত্তর থেকে আসা একটা মানুষের পক্ষে এটা খুবই কঠিন পরিবেশ। কারণ, আমি চিরকালই ঠান্ডা ও বরফের মধ্যে থেকে এসেছি। তবে একটা সপ্তাহ কাটানোর পরে এখন অনেকটা সয়ে গিয়েছে। এখন আগের চেয়ে অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করছি”।

আর ভারত সম্পর্কে তো কোনও ধারণাই ছিল না তাঁর। এই প্রসঙ্গে কাউকো বলেন, “আইএসএলে গতবারের ফাইনাল ম্যাচটা দেখেছি। বেশ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছিল সেই ম্যাচে। অনেক ঘটনাও ঘটেছিল। আর ভারতে এর আগে কখনও আসিনি আমি। সেই জন্যই তো এখানে এলাম। ভারতে আসার আগে আমার কোনও ধারণাই ছিল না, কোথায় যাচ্ছি। কিন্তু এসে দেখছি, সবাই আমাকে খুব পছন্দ করছে। এর চেয়ে খুশির আর কী হতে পারে?”

ফুটবলপ্রেমীরা অবশ্যই পছন্দ করছেন তাঁকে। পছন্দ করছেন অন্যান্য ক্লাবের কোচ, কর্তারাও। এটিকে মোহনবাগানের সঙ্গে এখনও এক বছরের চুক্তি বাকি তাঁর। তার পরে তিনি আইএসএলেই থেকে যাবেন, না অন্য কোনও দেশ দেখার ইচ্ছে হবে তাঁর, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। তবে আইএসএলে খেলতে এসে যে সাফল্য এবং গুরুত্ব তিনি পাচ্ছেন, তা বোধহয় ভুলতে পারবেন না কোনও দিনই।