লন্ডনের আইকনিক লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ভারত এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে তৃতীয় টেস্টের তৃতীয় দিনে (India vs England 3rd Test) নাটকীয় মুহূর্তের সাক্ষী হলো ক্রিকেট বিশ্ব। ভারতীয় অধিনায়ক শুভমান গিল এবং ইংল্যান্ডের ওপেনার জাক ক্রলির মধ্যে তীব্র বাক্যবিনিময় এই দিনের খেলাকে আরও রোমাঞ্চকর করে তুলেছে। প্রথম ইনিংসে উভয় দলের স্কোর ৩৮৭ রানে সমান হওয়ার পর, খেলার শেষ মুহূর্তে ক্রলির সময় নষ্ট করার কৌশল ভারতীয় দলকে ক্ষুব্ধ করে। কেএল রাহুলের দুর্দান্ত সেঞ্চুরি, ঋষভ পন্থ এবং রবীন্দ্র জাদেজার ফিফটি ভারতকে ইংল্যান্ডের স্কোরের কাছাকাছি নিয়ে গেলেও, নিম্ন ক্রমের ব্যাটিং ধস ভারতকে লিড নিতে বাধা দেয়। এই প্রতিবেদনে আমরা লর্ডসে তৃতীয় দিনের খেলার বিস্তারিত আলোচনা করব।
লর্ডসে শুভমান গিল-জাক ক্রলির দ্বন্দ্ব
তৃতীয় দিনের খেলা শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক মিনিট আগে, ইংল্যান্ডকে তাদের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে হয়েছিল। ভারতীয় দল ৩৮৭ রানে অলআউট হওয়ার পর, ইংল্যান্ডের ওপেনার জাক ক্রলি এবং বেন ডাকেট মাত্র এক ওভার খেলার জন্য মাঠে নামেন। কিন্তু ক্রলি বারবার সময় নষ্ট করার চেষ্টা করেন। তিনি প্রথমে ব্যাটিং পজিশন নিতে দেরি করেন এবং দ্বিতীয় বলের পরও ব্যাটিং থেকে সরে আসেন। এই কৌশল ভারতীয় অধিনায়ক শুভমান গিলকে ক্ষুব্ধ করে। গিল স্লিপ থেকে ক্রলিকে উদ্দেশ্য করে তীব্র ভাষায় কথা বলেন এবং ভারতীয় দলের অন্যান্য খেলোয়াড়রাও ক্রলির প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেন। পঞ্চম বলে ক্রলির আঙুলে বল লাগার পর তিনি আবার খেলা বন্ধ করেন, যা ভারতীয় দলের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দেয়। গিল এবং দলের সদস্যরা ক্রলির প্রতি সরব হয়ে ওঠেন এবং খেলা শুরু হওয়ার আগে তাকে উপহাস করে হাততালি দেন। জসপ্রীত বুমরাহর শেষ বলটি ক্রলির ব্যাটের বাইরের প্রান্তের খুব কাছ দিয়ে যায়, যা ভারতীয় দলকে উৎসাহিত করে। এই ঘটনা লর্ডসের দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং খেলার শেষ মুহূর্তটি অত্যন্ত নাটকীয় হয়ে ওঠে।
ভারতের প্রথম ইনিংস: কেএল রাহুলের সেঞ্চুরি এবং নিম্ন ক্রমের ধস
ভারত তাদের প্রথম ইনিংসে ৩৮৭ রানে অলআউট হয়, যা ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসের স্কোরের সঙ্গে ঠিক সমান। কেএল রাহুলের দ্বিতীয় লর্ডস সেঞ্চুরি (১০০ রান) ভারতের ইনিংসের মূল ভিত্তি ছিল। তিনি লর্ডসে দুটি বা তার বেশি সেঞ্চুরি করা প্রথম এশিয়ান ওপেনার হিসেবে ইতিহাস গড়েন। তবে, সেঞ্চুরির পরের বলেই তিনি আউট হন, শোয়েব বশিরের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে। ঋষভ পন্থ ৭৪ রানের একটি আক্রমণাত্মক ইনিংস খেলেন, যার মধ্যে একটি হুক শটে ছক্কা ছিল, কিন্তু লাঞ্চের আগে একটি অপ্রয়োজনীয় রান নেওয়ার চেষ্টায় রান আউট হন। রবীন্দ্র জাদেজা ৭২ রানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন, যা তাকে টেস্ট ক্রিকেটে টানা তিনটি ফিফটি স্কোর করার কৃতিত্ব এনে দেয়। তবে, জাদেজার আউট হওয়ার পর ভারতের নিম্ন ক্রম ধসে পড়ে। ৩৭৬ রানে জাদেজার উইকেট পড়ার পর, ভারত মাত্র ১১ রানে বাকি চার উইকেট হারায়, যার ফলে তারা ইংল্যান্ডের স্কোর ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। ওয়াশিংটন সুন্দর (২৩) এবং আকাশ দীপ (৭) কিছুটা প্রতিরোধ গড়লেও, জোফ্রা আর্চার এবং ক্রিস ওকসের বোলিং ভারতের লিড নেওয়ার সম্ভাবনা শেষ করে দেয়।
ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংস এবং বুমরাহর প্রায়-সাফল্য
ইংল্যান্ড তাদের দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র এক ওভার খেলে ২/০ স্কোরে দিন শেষ করে, যার ফলে তারা ভারতের তুলনায় ২ রানের লিড নিয়ে চতুর্থ দিনে খেলা শুরু করবে। জাক ক্রলি (২*) এবং বেন ডাকেট (০*) ক্রিজে ছিলেন। জসপ্রীত বুমরাহ, যিনি প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়ে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম তুলেছেন, দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথম ওভারে ক্রলির উইকেট প্রায় পেয়ে যান। তার একটি বল ক্রলির ব্যাটের বাইরের প্রান্তের খুব কাছ দিয়ে যায়, যা ভারতীয় দলকে উৎসাহিত করে। বুমরাহর এই বোলিং দক্ষতা চতুর্থ দিনে ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
কেএল রাহুলের ঐতিহাসিক কৃতিত্ব
কেএল রাহুলের ১০০ রানের ইনিংস ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। তিনি ১৭৭ বলে ১০০ রান করেন, যা তাকে লর্ডসে একাধিক সেঞ্চুরি করা দ্বিতীয় ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে (দিলীপ ভেঙ্গসরকরের পর) প্রতিষ্ঠিত করে। রাহুল এবং পন্থের ১৪১ রানের জুটি ভারতকে ইংল্যান্ডের স্কোরের কাছাকাছি নিয়ে যায়। তবে, রাহুলের আউট হওয়ার পর ভারত দ্রুত দুটি উইকেট হারায়, যা ইংল্যান্ডকে খেলায় ফিরিয়ে আনে।
ভারতের নিম্ন ক্রমের সমস্যা
ভারতের নিম্ন ক্রমের ধস এই টেস্টে তাদের একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। জাদেজা এবং নীতিশ কুমার রেড্ডি (৩০) ৭২ রানের একটি গুরুত্বপূর্ণ জুটি গড়লেও, তাদের আউট হওয়ার পর ভারত দ্রুত উইকেট হারায়। আকাশ দীপ দুটি ডিআরএস রিভিউয়ের মাধ্যমে আউট হওয়া থেকে বেঁচে যান, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জোফ্রা আর্চারের শর্ট বলে ওয়াশিংটন সুন্দর (২৩) আউট হন, যা ভারতের ইনিংস শেষ করে দেয়। এই ধস ভারতকে ইংল্যান্ডের স্কোর ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে।
চতুর্থ দিনের সম্ভাবনা
ইংল্যান্ড ২ রানের সামান্য লিড নিয়ে চতুর্থ দিন শুরু করবে। জসপ্রীত বুমরাহ এবং আকাশ দীপের বোলিং ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে, বিশেষ করে লর্ডসের পিচে সকালের অবস্থায় বল সুইং করার সম্ভাবনা থাকায়। শুভমান গিলের নেতৃত্বে ভারতীয় দল চতুর্থ দিনে দ্রুত উইকেট তুলে নিয়ে খেলায় আধিপত্য বিস্তার করতে চাইবে। অন্যদিকে, ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা, বিশেষ করে জো রুট এবং বেন স্টোকস, তাদের দ্বিতীয় ইনিংসে বড় স্কোর গড়তে চাইবে।
লর্ডসে তৃতীয় টেস্টের তৃতীয় দিনটি ছিল ক্রিকেটের নাটকীয়তা এবং উত্তেজনার একটি দুর্দান্ত প্রদর্শন। শুভমান গিল এবং জাক ক্রলির মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, কেএল রাহুলের ঐতিহাসিক সেঞ্চুরি, এবং ভারতের নিম্ন ক্রমের ধস এই দিনটিকে স্মরণীয় করে তুলেছে। জসপ্রীত বুমরাহর প্রায়-সাফল্য এবং ইংল্যান্ডের সময় নষ্ট করার কৌশল খেলাটিকে আরও রোমাঞ্চকর করে তুলেছে। চতুর্থ দিনে উভয় দলই নিজেদের শক্তি প্রমাণ করতে মরিয়া হবে, এবং এই টেস্ট ম্যাচটি একটি ঐতিহাসিক ফলাফলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।