ইস্টবেঙ্গল এফসি-র (East Bengal FC) প্রধান কোচ অস্কার ব্রুজো ২০২৪-২৫ এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগ থেকে দলের হৃদয়বিদারক বিদায়ের পর দলের ‘স্ব-ধ্বংসের সমস্যা’র জন্য দায়ী করেছেন। গতকাল বুধবার (১২ মার্চ ২০২৫) তুর্কমেনিস্তানের আরকাদাগ স্টেডিয়ামে এফকে আরকাদাগের কাছে ২-১ গোলে হেরে ইস্টবেঙ্গল টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যায়। ম্যাচের শুরুতেই রাফায়েল মেসি বউলির গোলে এগিয়ে গেলেও, দলের ভাগ্য বদলে যায় এবং শেষ পর্যন্ত তারা হার মানে।
ইস্টবেঙ্গল এফসি ম্যাচের প্রথম মিনিটেই গোল করে সমষ্টিগত স্কোর ১-১ করে। প্রথম লেগে কলকাতায় ১-০ গোলে হারের পর এই গোল দলের জন্য আশার আলো জ্বালায়। রাফায়েল মেসি বউলি দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে গোলটি করেন, যা দলের সমর্থকদের মধ্যে উৎসাহ জাগায়। কিন্তু ৩৩তম মিনিটে লালচুংনুঙ্গার লাল কার্ড সব আশা ভেঙে দেয়। দশ জনের দলে পরিণত হওয়ার পর ইস্টবেঙ্গল প্রথমার্ধে বেশ কিছু সুযোগ তৈরি করলেও, দ্বিতীয়ার্ধে তাদের গতি কমে যায়। আরকাদাগের বদলি খেলোয়াড় আলতিমিরাত আন্নাদুর্দিয়েভ ম্যাচের শেষ দিকে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেন। ৮৯তম মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে তিনি সমতা আনেন এবং ইনজুরি টাইমে বিজয়ী গোলটি করে আরকাদাগকে সেমিফাইনালে তুলে দেন।
Also Read | পয়েন্ট টেবিলে দশম, বিশেষ তালিকার পঞ্চম স্থানে ইস্টবেঙ্গল!
ম্যাচের পর অস্কার ব্রুজো তাঁর খেলোয়াড়দের প্রশংসা করেন এবং জোর দিয়ে বলেন যে তিনি বিশ্বাস করেন, ইস্টবেঙ্গল দুটি লেগেই ভালো দল ছিল। তিনি বলেন, “আরকাদাগকে জয়ের জন্য অভিনন্দন। আমার মনে হয় দুটি দলই খোলা মনে খেলেছে। এই মরশুমে আমাদের অনেক সমস্যা হয়েছে। বড় ম্যাচে, গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে, রেফারির সিদ্ধান্ত এবং ছোটখাটো বিষয়গুলো আমাদের বিরুদ্ধে গেছে। আমরা এমন একটি ক্লাব, যার স্ব-ধ্বংসের সমস্যা রয়েছে। আমি এই ফলাফল মেনে নিতে পারছি না। ছেলেরা তাদের সেরাটা দিয়েছে, যদিও প্রথম মিনিট থেকেই রেফারির বাইরের সিদ্ধান্ত ম্যাচকে প্রভাবিত করেছে। এই হার মেনে নেওয়া আমাদের জন্য কঠিন। আমি মনে করি, দুটি ম্যাচেই আমরাই ভালো দল ছিলাম। তবু আরকাদাগ এগিয়ে গেছে, তাদের অভিনন্দন।”
ব্রুজোর এই মন্তব্যে দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং বাইরের প্রভাবের প্রতি তাঁর হতাশা স্পষ্ট। তিনি বিশ্বাস করেন, ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়াড়রা তাদের সামর্থ্য দেখিয়েছে, কিন্তু ম্যাচের ফলাফল তাদের প্রচেষ্টার প্রতিফলন নয়।
ম্যাচের গতিপথ বদলে যায় ৩৩তম মিনিটে, যখন ডিফেন্ডার লালচুংনুঙ্গা দ্বিতীয় হলুদ কার্ড পেয়ে মাঠ ছাড়েন। এই ঘটনা ইস্টবেঙ্গলকে দশ জনের দলে পরিণত করে এবং আরকাদাগকে সংখ্যাগত সুবিধা দেয়। প্রথমার্ধে দলটি আক্রমণাত্মক খেলা চালিয়ে গেলেও, দ্বিতীয়ার্ধে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। লালচুংনুঙ্গার এই বিতর্কিত বহিষ্কার দলের কৌশল এবং মনোবলের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। সমর্থকদের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তীব্র ক্ষোভ দেখা গেছে। অনেকে মনে করেন, রেফারির কঠোর সিদ্ধান্ত ম্যাচের ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে।
আরকাদাগের জন্য ম্যাচের শেষ মুহূর্তগুলো ছিল নির্ণায়ক। ৮৯তম মিনিটে সৌভিক চক্রবর্তীর ফাউলের জন্য পেনাল্টি পায় তারা। আলতিমিরাত আন্নাদুর্দিয়েভ শান্তভাবে পেনাল্টি থেকে গোল করে সমতা ফেরান। এরপর ইনজুরি টাইমে তিনিই দ্রুত কাউন্টার অ্যাটাক থেকে বিজয়ী গোলটি করেন। এই দুটি গোল ইস্টবেঙ্গলের স্বপ্ন ভেঙে দেয় এবং আরকাদাগকে সেমিফাইনালে তুলে দেয়। সমষ্টিগত স্কোরে ৩-১ ব্যবধানে জিতে আরকাদাগ পরবর্তী রাউন্ডে যায়।
এই পরাজয়ের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের ২০২৪-২৫ মরশুমে এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগের যাত্রা শেষ হয়ে গেল। ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল)-এর প্লে-অফে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হওয়ার পর এই টুর্নামেন্টে ভালো করার আশা ছিল। কিন্তু প্রথম লেগে ১-০ এবং দ্বিতীয় লেগে ২-১ গোলে হেরে তাদের স্বপ্ন ভেঙে যায়। এখন দলের সামনে একটি দীর্ঘ বিরতি রয়েছে। তবে এপ্রিলে ২০২৫ সুপার কাপে অংশ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। অস্কার ব্রুজো আশা করছেন, এই প্রতিযোগিতায় তিনি তাঁর খেলোয়াড়দের থেকে সেরাটা বের করে আনতে পারবেন এবং মরশুমটি একটি শিরোপা জিতে শেষ করতে পারবেন।
ব্রুজোর মন্তব্যে ‘স্ব-ধ্বংসের সমস্যা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তা নিয়ে সমর্থকদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। এটি দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাহীনতা, খেলোয়াড়দের ভুল সিদ্ধান্ত, বা ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ব্যর্থতার ইঙ্গিত হতে পারে। লালচুংনুঙ্গার লাল কার্ড এই সমস্যার একটি উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এছাড়া, মরশুম জুড়ে দলটি বেশ কয়েকটি ম্যাচে সুযোগ হারিয়েছে, যা তাদের প্লে-অফের বাইরে রেখেছে। ব্রুজো মনে করেন, বাইরের প্রভাব যেমন রেফারির সিদ্ধান্তও তাদের বিরুদ্ধে গেছে। তবে তিনি দলের সম্ভাবনার প্রতি আশাবাদী এবং ভবিষ্যতে আরও ভালো ফলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরা এই হারে গভীরভাবে হতাশ। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে রেফারির সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। কেউ কেউ মনে করেন, দলের খেলোয়াড়দের শৃঙ্খলা এবং কৌশলগত প্রস্তুতির অভাবই এই হারের কারণ। অন্যরা ব্রুজোর নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, তিনি দলকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখাতে পারবেন।
ইস্টবেঙ্গলের জন্য এখন মরশুমের শেষ অংশে মনোযোগ দেওয়ার সময়। সুপার কাপ তাদের শেষ সুযোগ একটি শিরোপা জিতে সমর্থকদের মুখে হাসি ফোটানোর। অস্কার ব্রুজোর চ্যালেঞ্জ হবে দলের মনোবল ফিরিয়ে আনা এবং ‘স্ব-ধ্বংসের সমস্যা’ কাটিয়ে ওঠা। দলের তারকা খেলোয়াড়দের, যেমন দিমিত্রিওস দিয়ামান্তাকোস এবং রাফায়েল মেসি বউলির, উপর ভরসা রাখতে হবে। এই হারের পর ইস্টবেঙ্গলের প্রত্যাবর্তনই প্রমাণ করবে তাদের প্রকৃত শক্তি।
এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগে ইস্টবেঙ্গলের যাত্রা শেষ হয়েছে হতাশায়। তবে অস্কার ব্রুজোর কথায় আশার আলো রয়েছে। তিনি দলের সম্ভাবনায় বিশ্বাসী এবং ভবিষ্যতে সাফল্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এখন সমর্থকরা অপেক্ষায় রয়েছেন, দেখার জন্য দলটি কীভাবে এই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠে এবং সুপার কাপে নিজেদের প্রমাণ করে।