২০২৬ বিধানসভা ভোটের আগে ক্রিকেট মাঠে রাম-বাম!

আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন (Bengal Election 2026)। তার আগে থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো জনসংযোগে ব্যস্ত। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দল সিপিআইএম…

Cricket Match Sparks Political Storm

আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন (Bengal Election 2026)। তার আগে থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো জনসংযোগে ব্যস্ত। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দল সিপিআইএম এবং বিজেপির মধ্যে গোপন আঁতাতের অভিযোগ করে আসছিল। সেই অভিযোগ যেন বাস্তবে রূপ নিল পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরে একটি ক্রিকেট মাঠে। বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, দাসপুরের হরিরামপুরে একটি ক্লাব আয়োজিত ক্রিকেট টুর্নামেন্টের উদ্বোধনে একই মঞ্চে দেখা গেল সিপিআইএম নেতা তন্ময় ভট্টাচার্য এবং রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি তথা মেদিনীপুরের প্রাক্তন সাংসদ দিলীপ ঘোষকে। এই ঘটনা রাজনৈতিক মহলে জোরালো জল্পনার জন্ম দিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস এই ঘটনাকে হাতিয়ার করে ‘রাম-বাম’ যোগাযোগের কটাক্ষ ছুড়েছে।

Also Read | বাজল ভোটের বাদ্যি! নির্বাচনের গনগণে আঁচ সবুজ-মেরুন তাঁবুতে 

   

এদিন ক্রিকেট টুর্নামেন্টের উদ্বোধনে দিলীপ ঘোষ ও তন্ময় ভট্টাচার্যকে একসঙ্গে খেলার মাঠে দেখা গেছে। কখনো দিলীপ ঘোষ ব্যাট হাতে নেমেছেন, তন্ময় ভট্টাচার্য উইকেটকিপিং করেছেন। আবার কখনো তন্ময় ব্যাট করছেন, দিলীপ উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে। দুই বিরোধী দলের নেতার এই সহাবস্থান রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে প্রশ্ন তুলেছে। এই ঘটনা কি কেবল একটি সামাজিক অনুষ্ঠানের অংশ, নাকি এর পিছনে রয়েছে গভীর রাজনৈতিক তাৎপর্য? তৃণমূলের দাবি, এটি তাদের দীর্ঘদিনের অভিযোগের প্রমাণ—সিপিআইএম এবং বিজেপির মধ্যে গোপন সমঝোতা রয়েছে।

দুই নেতার বক্তব্য
এই ঘটনা নিয়ে তন্ময় ভট্টাচার্য বলেন, “এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের দুজনের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আয়োজকরা সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এখানে তৃণমূলের বিধায়ক থাকলেও কোনো সমস্যা হত না।” একই সুরে দিলীপ ঘোষ বলেন, “একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন হয়েছে। আমাদের দুজনকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, আমরা দুজনেই এসেছি। এখানে দেখা হয়েছে। আমরা পুরোনো বন্ধু, একসঙ্গে বিধানসভায় ছিলাম। একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেছি, গল্প হয়েছে। এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই।”

দুই নেতাই এই ঘটনাকে সাধারণ এবং সামাজিক বলে ব্যাখ্যা করলেও, রাজনৈতিক মহল এটিকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। বিশেষ করে তৃণমূল কংগ্রেস এই ঘটনাকে হাতিয়ার করে দুই দলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছে। তৃণমূলের এক নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, “আমরা অনেক দিন ধরে বলে আসছি, সিপিআইএম এবং বিজেপি গোপনে হাত মিলিয়েছে। এই ক্রিকেট মাঠের ঘটনা তারই প্রমাণ। এরা জনগণকে বিভ্রান্ত করছে।”

রাজনৈতিক পটভূমি
বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ উত্তপ্ত। তৃণমূল কংগ্রেস ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সিপিআইএম-এর প্রভাব ক্রমশ কমেছে। অন্যদিকে, বিজেপি গত এক দশকে রাজ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। তৃণমূলের অভিযোগ, এই দুই দল তাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে কাজ করছে। দাসপুরের এই ঘটনা তাদের সেই দাবিকে আরও জোরালো করেছে।

তন্ময় ভট্টাচার্য বর্তমানে সিপিআইএম-এর মধ্যে কোণঠাসা। সম্প্রতি এক মহিলা সাংবাদিকের অভিযোগের পর দলের রাজ্য কমিটি তার বিরুদ্ধে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দিলীপ ঘোষের সঙ্গে তার এই সহাবস্থান দলের অন্দরে এবং বাইরে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

দিলীপ ঘোষ, যিনি ২০২১ সালে মেদিনীপুর লোকসভা আসনে পরাজিত হয়েছিলেন, বর্তমানে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছেন। তবে রাজ্য বিজেপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং নেতৃত্বের পরিবর্তনের মধ্যে তিনি কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন। এই পরিস্থিতিতে তন্ময়ের সঙ্গে তার এই মেলামেশা বিজেপির অন্দরেও প্রশ্ন তুলেছে।

তৃণমূলের কটাক্ষ
তৃণমূল কংগ্রেস এই ঘটনাকে ‘রাম-বাম যোগাযোগ’ বলে কটাক্ষ করেছে। দলের এক মুখপাত্র বলেন, “একদিকে লাল, অন্যদিকে ভগবা—দুজনে মিলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। ক্রিকেট মাঠে এই দৃশ্য জনগণের সামনে সত্যটাকে তুলে ধরেছে।” তৃণমূলের দাবি, আগামী নির্বাচনে তাদের শক্তি কমাতে এই দুই দল গোপনে হাত মিলিয়েছে। তারা এই ঘটনার ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে ‘রাম-বাম’ জোটের অভিযোগ তুলেছে।

জনমানসে প্রভাব
দাসপুরের এই ঘটনা স্থানীয়দের মধ্যেও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। একজন বাসিন্দা বলেন, “এটা দেখে অবাক লাগল। যারা রাজনীতিতে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ে, তারা এখানে একসঙ্গে খেলছে। এটা কি শুধুই খেলা, নাকি এর পিছনে অন্য কিছু আছে?” আরেকজন বলেন, “এটা খেলার মাঠের বন্ধুত্ব হতে পারে, কিন্তু রাজনীতিতে এর অর্থ অনেক গভীর।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা সরাসরি কোনো জোটের ইঙ্গিত না দিলেও, এটি তৃণমূলের হাতে একটি প্রচারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। বিশ্লেষক শান্তনু পান বলেন, “তৃণমূল এই ঘটনাকে ব্যবহার করে জনগণের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করতে চাইছে। তবে এটি কেবল একটি সামাজিক অনুষ্ঠানও হতে পারে। এর বেশি তাৎপর্য দেওয়া ঠিক নয়।” তিনি আরও বলেন, “তন্ময়ের বর্তমান দলীয় অবস্থান এবং দিলীপের বিজেপির অভ্যন্তরীণ গতিবিধি এই ঘটনাকে আলোচনায় এনেছে।”

অন্যদিকে, সিপিআইএম-এর একাংশ এই ঘটনাকে দলের জন্য বিব্রতকর বলে মনে করছে। এক নেতা বলেন, “তন্ময়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে এই ধরনের ঘটনা দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে।” বিজেপির এক নেতাও বলেন, “দিলীপ ঘোষের এই পদক্ষেপ দলের কৌশলের সঙ্গে মেলে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।”

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল এই ঘটনাকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। বিশেষ করে পশ্চিম মেদিনীপুরে, যেখানে তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে, এই ঘটনা ভোটারদের মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারে। সিপিআইএম এবং বিজেপি এই অভিযোগের জবাবে কী বলে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ হবে।

ক্রিকেট মাঠে দিলীপ ঘোষ এবং তন্ময় ভট্টাচার্যের এই ‘রাম-বাম’ সহাবস্থান রাজনৈতিক মহলে তরঙ্গ তুলেছে। তৃণমূল এটিকে গোপন জোটের প্রমাণ বললেও, দুই নেতাই এটিকে সামাজিক ঘটনা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে এই ঘটনা আগামী দিনে রাজ্য রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে, তা সময়ই বলবে। বর্তমানে এটি কেবল একটি ক্রিকেট মাঠের ঘটনা হলেও, তৃণমূলের কটাক্ষ এবং জনগণের আলোচনায় এটি রাজনৈতিক রঙ ধরেছে। ২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে এই ধরনের ঘটনা কতটা গুরুত্ব পাবে, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশলের ওপর।