২০২৫ সালের ২৩ জুলাই ভারতীয় সংসদে ক্রীড়ামন্ত্রী মনসুখ লক্ষ্মণভাই মান্ডাভিয়া কর্তৃক উত্থাপিত ন্যাশনাল স্পোর্টস গভর্নেন্স বিল ২০২৫ ভারতের ক্রীড়া প্রশাসনের কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই বিলের প্রাথমিক খসড়ায় বলা হয়েছিল যে ভারতের সমস্ত জাতীয় ক্রীড়া সংস্থা, যার মধ্যে রয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (BCCI), রাইট টু ইনফরমেশন (RTI) আইন, ২০০৫ এর আওতায় আসবে। এই প্রস্তাব ক্রীড়া জগতে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল, বিশেষ করে বিসিসিআই-এর মতো সংস্থাগুলোর জন্য, যারা সরকারি তহবিলের উপর নির্ভর করে না। তবে, সাম্প্রতিক সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিলে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে, যা বিসিসিআই-এর জন্য বড় স্বস্তি এনেছে।
বিলের প্রাথমিক খসড়ার ধারা ১৫(২)-এ বলা হয়েছিল, “একটি স্বীকৃত ক্রীড়া সংস্থা এই আইনের অধীনে তার কার্যাবলী, দায়িত্ব এবং ক্ষমতার ক্ষেত্রে রাইট টু ইনফরমেশন আইন, ২০০৫-এর অধীনে একটি পাবলিক অথরিটি হিসেবে বিবেচিত হবে।” এই ধারা বিসিসিআই-এর মতো স্বাধীনভাবে পরিচালিত সংস্থাগুলোর মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল, কারণ তারা সরকারি তহবিল গ্রহণ করে না। বিসিসিআই, যিনি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রীড়া সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি, তাঁর আয় প্রধানত স্পনসরশিপ, মিডিয়া অধিকার এবং টিকিট বিক্রির মাধ্যমে আসে। ফলে, আরটিআই-এর আওতায় আসা তাদের প্রশাসনিক স্বাধীনতার উপর প্রভাব ফেলতে পারত।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া এর প্রতিবেদন অনুসারে, সংশোধিত ধারায় এখন বলা হয়েছে যে কেবলমাত্র সরকারি তহবিল বা সহায়তা প্রাপ্ত ক্রীড়া সংস্থাগুলোই আরটিআই-এর আওতায় পাবলিক অথরিটি হিসেবে বিবেচিত হবে। যেহেতু বিসিসিআই সরকারি তহবিলের উপর নির্ভর করে না, তাই তারা এখন আরটিআই-এর বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত। এই সংশোধনী বিসিসিআই-এর স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় জয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
জাতীয় ক্রীড়া সংস্থা হিসেবে বিসিসিআই-এর দায়িত্ব
যদিও বিসিসিআই আরটিআই-এর আওতা থেকে মুক্তি পেয়েছে, তবুও তাদের ন্যাশনাল স্পোর্টস গভর্নেন্স বিল ২০২৫-এর অধীনে একটি জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশন হিসেবে নিবন্ধন করতে হবে। এই বিলে অলিম্পিক এবং প্যারালিম্পিক ক্রীড়াগুলোর জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় থাকে। ২০২৮ সালের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে ক্রিকেটের ফিরে আসার কারণে বিসিসিআই-এর এই কাঠামোর মধ্যে থাকা বাধ্যতামূলক। এটি নিশ্চিত করবে যে বিসিসিআই আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) নিয়মাবলী মেনে চলে এবং ভারতীয় ক্রিকেটের প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়।
কেন আরটিআই থেকে মুক্তি গুরুত্বপূর্ণ?
বিসিসিআই-এর আরটিআই থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি ক্রীড়া জগতে বিতর্কিত হলেও এর পক্ষে যুক্তি রয়েছে। বিসিসিআই-এর মতো স্বাধীনভাবে পরিচালিত সংস্থাগুলোর জন্য আরটিআই-এর আওতায় আসা তাদের বাণিজ্যিক এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপের কারণ হতে পারে। বিসিসিআই-এর বার্ষিক আয় প্রায় ১৫,০০০ কোটি টাকার বেশি, যা মূলত আইপিএল, টিভি সম্প্রচার অধিকার, এবং স্পনসরশিপ থেকে আসে। এই আর্থিক স্বাধীনতা তাদের সরকারি তহবিলের উপর নির্ভরশীল অন্যান্য ক্রীড়া সংস্থা থেকে আলাদা করে। তবে, সমালোচকরা মনে করেন যে বিসিসিআই-এর মতো একটি জাতীয় সংস্থার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আরটিআই-এর আওতায় আসা উচিত, কারণ তারা জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রতিনিধিত্ব করে।
বিলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিক
ন্যাশনাল স্পোর্টস গভর্নেন্স বিল ২০২৫-এর লক্ষ্য হলো ভারতীয় ক্রীড়া প্রশাসনকে আরও স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। এর মধ্যে রয়েছে:
- ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড: ক্রীড়া সংস্থাগুলোর কার্যক্রম তদারকির জন্য একটি কেন্দ্রীয় বোর্ড গঠন।
- ক্রীড়াবিদদের প্রতিনিধিত্ব: ক্রীড়া সংস্থাগুলোর পরিচালনা পর্ষদে ক্রীড়াবিদদের ২৫% প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
- ডোপিং বিরোধী নীতি: বিশ্ব ডোপিং বিরোধী সংস্থার (WADA) নীতি মেনে চলা।
- বিরোধ নিষ্পত্তি: ক্রীড়া সংক্রান্ত বিরোধ দ্রুত সমাধানের জন্য একটি সালিশি কাঠামো গঠন।
এই বিল ভারতীয় ক্রীড়ার জন্য একটি নতুন দিশা নির্দেশ করলেও, বিসিসিআই-এর মতো সংস্থাগুলোর জন্য আরটিআই থেকে মুক্তি তাদের স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে সাহায্য করবে। তবে, জাতীয় ফেডারেশন হিসেবে নিবন্ধন এবং অলিম্পিক নীতি মেনে চলার মাধ্যমে বিসিসিআই-এর উপর কিছু নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
সমাজের প্রতিক্রিয়া
সামাজিক মাধ্যমে এই সংশোধনী নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একদল মনে করেন, বিসিসিআই-এর মতো একটি শক্তিশালী সংস্থার আরটিআই-এর আওতায় থাকা উচিত ছিল, যাতে তাদের আর্থিক লেনদেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়। অন্যদিকে, বিসিসিআই-এর সমর্থকরা বলছেন, সরকারি তহবিল ছাড়া পরিচালিত সংস্থার উপর আরটিআই চাপিয়ে দেওয়া তাদের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করত।
অলিম্পিকের প্রেক্ষিতে বিসিসিআই
২০২৮ সালের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে ক্রিকেটের অন্তর্ভুক্তি বিসিসিআই-এর জন্য নতুন দায়িত্ব নিয়ে এসেছে। অলিম্পিকের নিয়ম অনুসারে, বিসিসিআই-এর জাতীয় ফেডারেশন হিসেবে নিবন্ধন এবং আইওসি-র নির্দেশনা মেনে চলা বাধ্যতামূলক। এটি বিসিসিআই-এর কার্যক্রমে কিছু স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিয়ে আসবে, যদিও আরটিআই-এর আওতা থেকে তারা মুক্ত থাকবে।
ন্যাশনাল স্পোর্টস গভর্নেন্স বিল ২০২৫ ভারতীয় ক্রীড়ার জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করছে। বিসিসিআই-এর আরটিআই থেকে মুক্তি তাদের স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখলেও, জাতীয় ফেডারেশন হিসেবে নিবন্ধন এবং অলিম্পিক নীতি মেনে চলার মাধ্যমে তারা ভারতীয় ক্রিকেটের প্রশাসনিক মান উন্নত করতে বাধ্য থাকবে। এই সংশোধনী ক্রীড়া জগতে স্বচ্ছতা এবং স্বাধীনতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার একটি প্রচেষ্টা। ভবিষ্যতে এই বিল কীভাবে ক্রীড়া সংস্থাগুলোর কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।