Argentina: টর্চারসেলে গুলির শব্দে চিৎকার ‘লিবার্তে’, বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনায় চলছিল বামপন্থীদের গণহত্যা

সামরিক সরকার (Military Junta) বনাম গণতন্ত্রপন্থীদের সংঘর্ষের (Argentina Civil War 1978) রক্তাক্ত এই অধ্যায়টি বিশ্ব ফুটবলের  কালো অধ্যায়। নীল-সাদা আর্জেন্টিনার ফুটবল জার্সির এ এক ভয়াবহ…

সামরিক সরকার (Military Junta) বনাম গণতন্ত্রপন্থীদের সংঘর্ষের (Argentina Civil War 1978) রক্তাক্ত এই অধ্যায়টি বিশ্ব ফুটবলের  কালো অধ্যায়।

নীল-সাদা আর্জেন্টিনার ফুটবল জার্সির এ এক ভয়াবহ সাদা-কালো দিক

টক টক টক টক…সহসা রাতের কড়ানাড়া
দিয়েগো বাড়ি আছ?
ইলা বাড়ি আছ?
আর্মান্দো বাড়ি আছ?
হেনরিয়েটা বাড়ি আছ?

এমনই হাজার খানেক নামের তালিকায় বেশিরভাগই ‘নিরুদ্দেশ’-‘মৃত’। আর্জেন্টিনার (Argentina) ঘরে ঘরে আছে এই নামগুলো। ভয়াবহ রাতে তুলে নিয়ে যাওয়া দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ও গণতন্ত্রী মতবাদে বিশ্বাসী সেদিনের যুব আর্জেন্টিনীয়রা চার দশক পরও আলোচিত হন।

বুয়েনস আয়ার্সের রাস্তায় এদিক ওদিক লেজ গুটিয়ে শুয়ে থাকা কুকুরগুলো গণ অপহরণ-হত্যার নীরব সাক্ষী ছিল। নীলচে-কালো পোশাকের সেনা অফিসারের হাতে সাইলেন্সার লাগানো রিভলভারের নলটা মাথার উপরে মৃত্যু স্পর্শ করতেই দৃঢ় কণ্ঠে কমিউনিস্ট কর্মী ইলা বলেছিল ‘লিবার্তে… ভিভা আর্জেন্টিনা।’ (স্বাধীনতা স্বাগত…জয় আর্জেন্টিনা)

আর্জেন্টিনার সামরিক সরকারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে (নির্যাতন শিবির) ইলার ঘোষণা আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির বন্দুকের সামনে মিত্রপক্ষের কিংবদন্তি গুপ্তচর নূর ইনায়ত খানের শেষ মুহূর্তের শেষ কথাটি হুবহু বসানো -‘লিবার্তে’ (স্বাধীনতা)।

ইলা, দিয়েগো, আর্মান্দো, হেনরিয়েটা এমনই সব নিখোঁজ-মৃত হাজার হাজার নাম। বন্দি শিবির থেকে ভেসে আসা চিৎকার মিশে যেত আটলান্টিকের নোনা হাওয়ায়। বুয়েনস আয়ার্সের রাজপথে সন্তানের দেহ পেতে দীর্ঘ অপেক্ষায় মা দা়ঁড়িয়ে। বিশ্বকাপ ফুটবলের তুমুল উন্মাদনার মাঝে সেও এক ভয়াবহ দৃশ্য। যে মুহূর্তগুলো আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলির পাঠানো খবর ও ছবিতে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। বিশ্বকাপ ফুটবল এলেই আর্জেন্টিনার ঘরে ঘরে ফুটবলের উন্মাদনায় মিশে থাকে হাজার হাজার গণতন্ত্রী বিদ্রোহীদের নাম।

১৯৭৮ সালের আর্জেন্টিনা। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে তখন সামরিক শাসন চলছিল। আর তার বিরুদ্ধে চলছিল গণতন্ত্রের কায়েম করার সংঘর্ষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন মদত আছে। ফলে আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপ আয়োজনের দাবি জোরালো। গৃহযুদ্ধ চলার মাঝে বিশ্বকাপ হওয়া নিয়ে কে দেবে ভেটো? এদিকে ১৯৬৬ সাল থেকে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে চিহ্নিত।

সামরিক শাসন বনাম আর্জেন্টিনার কমি়উনিস্ট ও বাম সংগঠনগুলির সংঘাত চলছিল তীব্র। বুয়েনস আয়ার্সের ঘরে ঘরে রাতে অন্ধকারে তল্লাশি চালিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হত যুবক যুবতীদের। বিশ্ব জুড়ে সমালোচনা চলছে প্রেসিডেন্ট ভিদেলার। তিনি চাইলেন বিশ্বকাপের জৌলুসে সব ঢাকতে। সেই সাথে দিলেন বার্তা বিশ্বকাপ চাই।

ভিদেলার হুঙ্কারে ফিফা কাঁপছে। একের পর এক গড়াপেটা ম্যাচে আর্জেন্টিনার জয় আসছে। অবশেষে এলো সেই দিন, ১৯৭৮ সালের ২১ জুন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে আছে আর্জেন্টিনা-পেরুর সেই ম্যাচ। দুই দেশের সরকার ঠিক করে নেয়, ম্যাচ জিতবে আর্জেন্টিনা। ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড পাওয়া আর ১৩ জন বন্দিকে রাজনৈতিক বন্দির সম্মান দেওয়ার শর্তে আর্জেন্টিনাকে ম্যাচটি ছেড়ে দিয়েছিল পেরু। আর্জেন্টিনা উঠল ফাইনালে।

ফাইনালে আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হল্যান্ড (নেদারল্যান্ডস)। তীব্র গা জোয়ারির খেলায় ৩-১ গোলে জয়ী হয় আর্জেন্টিনা। তার পর গণজোয়ার রাজপথে। সেও সাজানো। বন্দুকের ইশারায় উল্লাস চলছে।

বুয়েনস আয়ার্সের রিভার প্লেটের যে স্টেডিয়ামে তখন খেলা হতো তার মাত্র এক মাইল দূরে ছিল সামরিক সরকারের বন্দি শিবির নেভি স্কুল অব ম্যাকনিকস। বৃটিশ ফটোগ্রাফার রাইট থম্পসন বিশ্বকাপের ছবি তুলতে গেছিলেন। তিনি ‘ডার্টি ওয়ার’ বইতে লিখেছেন যখন স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনার ম্যাচ চলত তখন ওই টর্চারসেল থেকে কান্নার শব্দ শোনা যেত। 

নীল-সাদা আর্জেন্টিনার ফুটবল জার্সির এ এক ভয়াবহ সাদা-কালো দিক। ১৯৮৩ সালে স্বৈরাচারী ভিদেলার শাসন শেষ হয়। রক্তাক্ত গণবিক্ষোভের পর এই দেশে ফিরে আসে গণতন্ত্র।