ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে আন্দ্রে রাসেল (Andre Russell) একটি পরিচিত নাম। তাঁর বিস্ফোরক ব্যাটিং এবং দ্রুত গতির বোলিং তাঁকে বিশ্ব ক্রিকেটে একজন টি-টোয়েন্টি সুপারস্টারে পরিণত করেছে। গত বুধবার, ২৩ জুলাই, ২০২৫, জ্যামাইকার সাবিনা পার্কে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়েছেন। এই ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৮ উইকেটে পরাজিত হলেও, রাসেল তার স্বভাবসুলভ ধ্বংসাত্মক ব্যাটিংয়ের মাধ্যমে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। মাত্র ১৫ বলে ৩৬ রানের একটি ঝড়ো ইনিংস খেলে তিনি সাবিনা পার্কের দর্শকদের উপহার দিয়েছেন একটি অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। তাঁর একটি ছক্কা সাইটস্ক্রিনে ছিদ্র করে, যা ম্যাচের অন্যতম আলোচিত ঘটনা হয়ে উঠেছে।
রাসেলের বিদায়ী ম্যাচ: এক ঝলক
দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথমে ব্যাট করে ২০ ওভারে ৮ উইকেটে ১৭২ রান সংগ্রহ করে। ম্যাচের শুরুটা ভালো হলেও, মিডল অর্ডারে ধস নামে এবং ১৪তম ওভারে দলের স্কোর ছিল ৯৮/৫। এই পরিস্থিতিতে মাঠে নামেন আন্দ্রে রাসেল। তিনি তার শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ঝড় তুলতে দেরি করেননি। ১৫তম ওভারে অস্ট্রেলিয়ান পেসার বেন ডোয়ারশুইসের বিরুদ্ধে তিনি প্রথম বলেই একটি দুর্দান্ত ডাউন দ্য গ্রাউন্ড শট খেলেন, যা সরাসরি সাইটস্ক্রিনে আঘাত করে এবং তাতে একটি ছিদ্র তৈরি করে। এই ওভারে রাসেল আরও দুটি ছক্কা মেরে মোট ১৯ রান আদায় করেন। তাঁর এই বিস্ফোরক ব্যাটিং সাবিনা পার্কের দর্শকদের উৎসাহে মুখরিত করে তোলে।
তবে, রাসেলের এই ঝড়ো ইনিংস বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ১৮তম ওভারে নাথান এলিসের একটি স্লোয়ার বলে তিনি বিভ্রান্ত হন এবং উচ্চ টপ-এজড শট খেলে জশ ইংলিসের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হন। ১৫ বলে ৩৬ রানের এই ইনিংসে তিনি ২টি চার এবং ৪টি ছক্কা মারেন, যা তাঁর টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের স্বাক্ষর বহন করে। তাঁর এই ইনিংস ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৭২ রানের লড়াকু স্কোরে পৌঁছাতে সহায়তা করে, তবে অস্ট্রেলিয়ার জশ ইংলিস (৭৮* রান, ৩৩ বল) এবং ক্যামেরন গ্রিন (৫৬* রান, ৩২ বল) এর বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের কাছে এই রান যথেষ্ট ছিল না। অস্ট্রেলিয়া মাত্র ১৫.২ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে যায়।
রাসেলের বিদায়ী মুহূর্ত
ম্যাচের শুরুতে রাসেল যখন মাঠে নামেন, তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়রা তাঁকে গার্ড অফ অনার প্রদান করেন। জ্যামাইকার ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রী অলিভিয়া গ্রেঞ্জ তাঁকে একটি স্মারক উপহার দেন। সাবিনা পার্কের দর্শকরা তাঁর প্রতিটি শটে উল্লাস করেন এবং তাঁর আউট হওয়ার পরও দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনায় রাসেল বলেন, “সাবিনা পার্কের দর্শকদের এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ফলাফল আমাদের পক্ষে যায়নি, তবে এতগুলো ম্যাচ খেলে এবং নিজের দেশের দর্শকদের সামনে পারফর্ম করতে পেরে আমি খুশি।” তিনি আরও বলেন, “২০১২ এবং ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয় আমার ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। এখন সময় এসেছে এগিয়ে যাওয়ার, আমাদের দলে রাদারফোর্ড, আলজারি জোসেফ এবং হোল্ডারের মতো তরুণ প্রতিভা রয়েছে।”
রাসেলের ক্যারিয়ার: এক নজরে
আন্দ্রে রাসেল ৮৫টি টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ১০৮৬ রান স্কোর করেছেন এবং ৬১টি উইকেট নিয়েছেন। তিনি ২০১২ এবং ২০১৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ২০১৬ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ভারতের বিরুদ্ধে ২০ বলে অপরাজিত ৪৩ রানের ইনিংস তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা মুহূর্ত। এছাড়া, তিনি ৫৬টি ওয়ানডে এবং একটি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তাঁর স্ট্রাইক রেট ১৭৭.১১, যা তাঁর ধ্বংসাত্মক ব্যাটিং ক্ষমতার প্রমাণ।
রাসেলের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে অবদানও অসাধারণ। তিনি কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে ২০১৪ এবং ২০২৪ সালে আইপিএল শিরোপা জিতেছেন। এছাড়া, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ, বিগ ব্যাশ লিগ, এবং বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে তিনি একাধিক দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁর দ্রুত গতির বোলিং এবং বিশাল ছক্কা মারার ক্ষমতা তাঁকে বিশ্বের বিভিন্ন টি-টোয়েন্টি লিগে একজন পছন্দের খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে।
ম্যাচের ফলাফল এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রাধান্য
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৭২ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া শুরুতে কিছুটা চাপে পড়ে, যখন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল এবং মিচেল মার্শ দ্রুত আউট হন। তবে, জশ ইংলিস এবং ক্যামেরন গ্রিনের ১৩১ রানের অবিচ্ছিন্ন তৃতীয় উইকেটের জুটি ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে। ইংলিস ৩৩ বলে ৭৮* রান এবং গ্রিন ৩২ বলে ৫৬* রান করে অস্ট্রেলিয়াকে ২৮ বল বাকি থাকতেই জয় এনে দেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফিল্ডিংও এই ম্যাচে হতাশাজনক ছিল, কারণ তারা পাঁচটি ক্যাচ ফেলে। রাসেল নিজেও ইংলিস এবং মার্শের ক্যাচ ফেলেন, এবং তাঁর একমাত্র ওভারে ১৬ রান দেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেও, রাসেল ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে খেলা চালিয়ে যাবেন। তিনি ইতিমধ্যেই কলকাতা নাইট রাইডার্স, ত্রিনবাগো নাইট রাইডার্স এবং অন্যান্য লিগে নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন। তাঁর এই বিদায়ী ম্যাচে দেখা গেছে, তিনি এখনও তাঁর শীর্ষ ফর্মে রয়েছেন এবং ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে তাঁর প্রভাব অব্যাহত থাকবে।
আন্দ্রে রাসেলের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। সাবিনা পার্কে তাঁর শেষ ম্যাচে তিনি প্রমাণ করেছেন কেন তিনি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের একজন কিংবদন্তি। সাইটস্ক্রিনে ছিদ্র করা ছক্কা থেকে শুরু করে দর্শকদের উৎসাহ, সবকিছুই তাঁর ক্যারিয়ারের সারাংশ বহন করে। পশ্চিমবঙ্গের ক্রিকেটপ্রেমীরা, বিশেষ করে কলকাতার সমর্থকরা, তাঁর আইপিএল পারফরম্যান্সের মাধ্যমে তাঁকে আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাবেন। রাসেলের এই বিদায় ক্রিকেট বিশ্বে একটি শূন্যতা তৈরি করলেও, তাঁর উত্তরাধিকার চিরকাল জ্বলজ্বল করবে।