Kolkata Durga Puja: হাওড়ার এই গ্রামের মুসলিম শিল্পীরা না থাকলে হয়ত চুলের আকাল পড়ত গোটা বঙ্গ জুড়ে। না না, আমার আপনার মাথার চুল যা আছে সেটা ঠিকঠাকই থাকতো। কিন্তু মা দুর্গা থেকে শুরু করে তার সন্তান-সন্ততি এমনকি বঙ্গের যত দেবদেবী আছেন, হয়তো বিপদে পড়তেন তাঁরা। বিপদ বলতে তাঁদের মূর্তির মাথায় যে ঘন কালো কোঁকড়া চুলের বহর আমরা দেখতে পাই, তা হয়তো দেখা নাও যেতে পারত।
হাওড়ার সাঁতরাগাছি-আমতা সেকশনে ছোট্ট গ্রাম পার্বতীপুর। গ্রামের জনসংখ্যার অধিকাংশই মুসলিম ধর্মাবলম্বী। কিন্তু তাদের মূল জীবিকাই হল হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির জন্য চুল বানানো। যে পাট থেকে বস্তা তৈরি হয় সুতলি দড়ি চট তৈরি হয় সেই পাট দিয়েই তৈরি হয় প্রতিমার ঘন কালো চুল। তবে কাজটা মোটেও সহজ নয়। বেশ কিছু জটিল প্রক্রিয়ার পরে পাটকে এরকম কোঁকড়ানো চুলের পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়।
প্রায় ৬০ বছর আগে, গ্রামের এক মুসলিম যুবক এই কাজ শুরু করেছিলেন। তারপর থেকেই গোটা গ্রামের উপার্জনের মূল রাস্তা হয়ে দাঁড়ালো এই চুল বানানোর পেশা। সেই যুবক এখন বৃদ্ধ হয়েছেন। শুরুর দিনকার থেকে এখনকার কারিগরির ধরন অনেকটাই পাল্টেছে। কিন্তু ষাট বছর আগে একলাখি চাচা যে ট্র্যাডিশন শুরু করেছিলেন তা আজব পার্বতীপুর গ্রামের ঘরে ঘরে বয়ে চলেছে সমানতালে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কুমোরটুলি থেকে শুরু করে ভিন রাজ্যেও পার্বতীপুর গ্রামের তৈরি চুলের কদরই আলাদা। কার্যত তাদের ছাড়া যেন মৃৎশিল্প জগতের ফিনিশিং টাচ অচল।
প্রতিমার চুল বানানোর জন্য খুবই ভালো মানের পাটের দরকার পড়ে। যে পাটের ফাইবার যত ভালো সেই পাট থেকে তত ভালই চুল তৈরি হবে। প্রথমে বিভিন্ন কেমিক্যাল রং মিশিয়ে পাটে ডাই করতে হয় অর্থাৎ রং করতে হয়। রংয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত কালো রংয়ের চুলের চাহিদাই বেশি। এছাড়াও বার্গান্ডি এবং ব্রাউন কালারের চুলেরও চাহিদা রয়েছে। সাধারণত শিবের মূর্তিতেই এই ব্রাউন বা বার্গান্ডি চুল লাগানো হয়।
চুলের ধরনেরও অনেক রকম তফাৎ রয়েছে। মৃৎশিল্পী চুল কারিগরদের ভাষায় তাদের ভিন্ন ভিন্ন নামও রয়েছে। যেমন কাঠি চুল, ফেসো, সাদা ফেসো, ক্রেপ চুল ইত্যাদি। পাটের কাঠির উপরে প্যাঁচানো চুলকে কাঠি চুল বলা হয়। একটা সময় এই চুলই মার্কেটে প্রচলিত ছিল। পরবর্তী সময়ে আসে ক্রেপচুল। নাইলন সুতোর উপরে বিনুনি করা চুলের মতো পাট পেঁচিয়ে গুটিয়ে তৈরি হয় এই চুল। সুতো কেটে চুলের জট খুলে মৃৎশিল্পীরা তাদের ইচ্ছেমতো চুল লাগিয়ে নেন। অপরদিকে চুলের ভলিউম বাড়াবার জন্য কালো ব্যবহার করা হয় যাতে কোন বিনুনি বা কোকড়ানোভাব থাকে না। আবার অন্য দিকে সিংহের কেশর তৈরীর জন্য ব্যবহার করা হয় সাদা ফেসো যাতে কোনো রকম কালো রং থাকে না।
পার্বতীপুর গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে চলে এই পাটের চুল তৈরির কাজ। সাধারণত আমরা নতুন জিনিসকেই ভালো বলে মনে করি। কিন্তু পাটের চুলের ক্ষেত্রে ধারণাটা ঠিক উল্টো। এই চুল যত পুরনো হবে তত এর ফিনিশিং এবং প্রতিমার উপরে সেটিংস ভালো হবে। সেই জন্য মৃৎশিল্পীরা কমপক্ষে বছরখানেক আগের তৈরি চুল ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। পার্বতীপুর গ্রামে গেলে দেখা যাবে শুধু বাড়িতে নয় স্থানীয় মসজিদ প্রাঙ্গনেও প্রতিমার চুল তৈরি হচ্ছে।
তবে অন্যান্য ব্যবসার মতো এই ব্যবসাতেও বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা এখন দেখা যাচ্ছে। প্রথমত পাটের চুল পালিশ করবার সময় তৈরি হওয়া ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র আঁশ বা ধুলো থেকে শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা একটা সাধারণ বিষয়। তার উপরে ভালো মানের পাটের যোগান ক্রমশই কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এখানেও বিভিন্ন মেশিনপত্রের ব্যবহার শুরু হওয়ায় ম্যানুয়ালি কাজ করা কারিগরদের জীবিকায় টান পড়ছে। তা সত্ত্বেও সারা বছর ধরে কাজ চলাতে খুব অসুবিধা হচ্ছে না বলেই তাদের দাবি।
আমরা কথায় কথায় হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির কথা বলি। দূর্গা পূজার মরশুমে আপনার সামনে থাকা দুর্গা প্রতিমা যেন সেই সম্প্রীতিরই উজ্জ্বল উদাহরণ। হিন্দু দেবদেবীর প্রতিমার সৌন্দর্য বাড়ছে মুসলমান শিল্পীদের হাতে। বিভিন্ন দুর্গাপুজোর ব্যানারে আমরা দেখতে পাই লেখা থাকে ‘সর্বজনীন দুর্গোৎসব’। সর্বজনীন অর্থাৎ সর্বজন-এর অংশগ্রহণ।
হাওড়ার পার্বতীপুর এর গ্রামের মানুষজন যেন সেই সর্বজনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গত ৬০-৭০ বছর ধরে। এবং আগামী দিনেও তাদেরকে ছাড়া কুমোরটুলি প্রতিমা শিল্প বা মৃৎশিল্প কার্যত অচল বলা যেতে পারে। শিল্প-ধর্মের সর্বজন সমন্বয়ের এর থেকে ভাল উদাহরণ আর কী হতে পারে!