প্রকাশ্য জনসভায় মুখ ফস্কে গালাগালি। সিপিআইএম নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের (Minakshi Mukherjee ) ভাষণ এখন রাজ্য রাজনীতির অন্যতম বিতর্কিত বিষয়। নদিয়ার কালীগঞ্জে সিপিআইএমের জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে নাম না করে তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষকে তীব্র আক্রমণ করেন মীনাক্ষী। তারই মধ্যে তাঁর মুখে শোনা যায় একাধিক অশ্রাব্য শব্দ। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে জোর বিতর্ক। তৃণমূল নেতৃত্বের তরফে এখনও পর্যন্ত সরাসরি প্রতিক্রিয়া না মিললেও, সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে মীনাক্ষীর এই ভাষার ব্যবহার ঘিরে বামেদের অন্দরে তৈরি হয়েছে মতবিভাজন। একদিকে যেমন সমর্থক মহলের একাংশ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন, তেমনই অনেকেই একে ‘অপ্রয়োজনীয় ও বিপজ্জনক’ কৌশল বলে আখ্যা দিচ্ছেন।
কী ঘটেছিল কালীগঞ্জে?
শনিবার, নদিয়ার কালীগঞ্জে সিপিআইএমের সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মীনাক্ষী মুখার্জী আক্রমণ করেন তৃণমূলের একাধিক নেতাকে। যদিও কারও নাম উল্লেখ করেননি, তবে তীব্র আক্রমণের লক্ষ্য যে কুণাল ঘোষ, তা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেই দিয়েছেন। সেই ভাষণের মধ্যেই একাধিক অশ্রাব্য শব্দ ব্যবহার করেন মীনাক্ষী। সংবাদমাধ্যমে সেই ক্লিপ ভাইরাল হতেই শুরু হয় বিতর্ক।
প্রচারের আলোয় মীনাক্ষী
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসেন মীনাক্ষী। তারই প্রেক্ষিতে বামপন্থী মহলে তৈরি হয়েছে দ্বিমত। অনেকেই মনে করছেন, এই বিতর্কের ফলে সিপিআইএম আবার আলোচনায় এসেছে, যা দীর্ঘদিন ধরেই দলীয় কর্মীদের অভাব ছিল।
বামপন্থী চিত্রপরিচালক ও সমাজকর্মী সৌরভ পালোধী এ বিষয়ে ফেসবুকে লেখেন,
“কেমন ভাবে কথা বললে মিডিয়া নড়ে চড়ে বসে দেখা গেল তো? এটা না বললে কালকের মীনাক্ষীর ওই আলোচনার ফুটেজ দেখানো হতো?”
এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছেন, ভাষার মাত্রাজ্ঞানে হোক বা না হোক, মীনাক্ষী নিজের বক্তব্যে সাড়া ফেলেছেন।
সমর্থনে এবং বিরোধিতায় কণ্ঠ
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক সমর্থক কমেন্টে লেখেন,
“মীনাক্ষী যে উচ্চশিক্ষিতা, রুচিশীল এক বাম নেত্রী, তাঁর ভাষণে তিনি প্রমাণ দিয়েছেন। আগামী দিনে সিপিআইএম কী ভাষায় বিরোধিতা করবে, তার স্পষ্ট রূপরেখা তিনি দিয়েছেন। সাবাস!”
অর্থাৎ, শালীনতার বাইরে গিয়ে হলেও মীনাক্ষী একপ্রকার রাজনৈতিক ‘লাইমলাইট’ জিতে নিয়েছেন বলেই মনে করছেন অনেকে।
তবে এর বিরুদ্ধেও কড়া মত উঠে এসেছে। পম্পা দাস নামের এক বামপন্থী সমর্থক লিখেছেন,
“বুঝলাম, ঐ জনসভার মূল উদ্দেশ্য তাহলে ছিল মিডিয়া ফুটেজ। এটা যে রাজনৈতিক ভাবে দলকে পিছিয়ে দেওয়া, এই বোধটুকুও কি নেই?”
তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট, রাজনীতিতে ভাষার পরিশীলন জরুরি এবং নেত্রী মীনাক্ষীর এই ধরণের আচরণ দলকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে।
পালটা বক্তব্য রাখতে গিয়ে সাত্যকি ভট্টাচার্য নামে একজন লেখেন,
“যেকোনও রাজনীতির উদ্দেশ্য প্রচার। প্রচার না হলে সেটা রাজনীতি নয়। এই বক্তব্য আমাদের পিছিয়ে দেয়নি বরং মানুষ এই ভাষা রিলেট করতে পেরেছে। বহুদিন বাদে সিপিআইএম ‘ভদ্র’ ইমেজ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, এটা আমি অন্তত স্বাগত জানাই।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, এই ধরনের ‘আক্রমণাত্মক ও তীব্র’ ভাষার ব্যবহার মূলত জনমানসে প্রবেশ করার কৌশল হতে পারে। মীনাক্ষীর কণ্ঠে যেভাবে মেজাজ হারানো ভাষা উঠে এসেছে, তা ইচ্ছাকৃত না হলেও রাজনৈতিক ভাবে লাভদায়ক হতে পারে।
তবে এর একটি ‘দ্বৈত ফল’ও রয়েছে বলে মত তাঁদের। যেমন—
একটি অংশের মানুষ যেভাবে উৎসাহিত হচ্ছে, অন্য একটি অংশ ক্ষুব্ধও হচ্ছে।
‘নব্য’ বনাম ‘পুরাতন’ সিপিআইএম বিতর্ক?
এই বিতর্ক থেকে স্পষ্ট, সিপিআইএমের ভেতরেই এক ‘নব্য’ বনাম ‘পুরাতন’ মতাদর্শের সংঘাত ক্রমেই প্রবল হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, মীনাক্ষীর মতো তরুণ নেতৃত্ব যখন ভাষা ও পন্থায় আগ্রাসী, তখন দলের বহু পুরনো কর্মী ও সমর্থকের মধ্যে এক ধরণের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে।
পম্পা দাস পুনরায় লেখেন,
“যাঁরা হরেকৃষ্ণ কোনারের পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁরা এই ভাষা শুনে হতবাক। রাজনীতির পাঠ তাঁরা অন্তত এই নতুনদের কাছ থেকে নিতে চাইবেন না বলেই মনে হয়।”
সার্বিকভাবে বলা যায়, মীনাক্ষী মুখার্জীর এই বক্তব্যে সিপিআইএম আবার আলোচনায় এসেছে ঠিকই, তবে সমর্থনের সঙ্গে সঙ্গে নিন্দাও প্রবল। বাম রাজনীতির নতুন ভাষা কী হবে, সেটা ভবিষ্যত বলবে। তবে এটুকু নিশ্চিত যে, মীনাক্ষীর মুখের ‘কুকথা’ এখন রাজ্যের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে। এই বিতর্ক থেকেই উঠে