মহালয়ার আবেগ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, ফুটবলের ধারাভাষ্য দিতে ঘটিয়েছিলেন লজ্জাকর কাণ্ড

রাত পোহালে বুধবার মহালয়া। আর এই মহালয়া বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র (Birendra Krishna Bhadra) ছাড়া ভাবাই যায় না । কিন্তু তিনিই ছিলেন প্রথম ক্রীড়া ধারা ভাষ্যকারদের অন্যতম…

Birendra Krishna Bhadra

রাত পোহালে বুধবার মহালয়া। আর এই মহালয়া বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র (Birendra Krishna Bhadra) ছাড়া ভাবাই যায় না । কিন্তু তিনিই ছিলেন প্রথম ক্রীড়া ধারা ভাষ্যকারদের অন্যতম এটা ক’জন জানেন। 

রেডিয়োতে খেলার রিলে শোনা এক অদ্ভুত আনন্দ ছিল। অডিও ভিজ্যুয়াল আসার আগে সারা বিশ্বে এটাই ছিল পদ্ধতি। বাংলায় এই খেলার রিলে বলা এক অনন্য মাত্রা পেয়েছিল পঞ্চাশের দশক থেকে। তারপর থেকে রেডিওতে ধারাভাষ্যের মাধ্যমে মানুষকে মানসচক্ষে খেলা দেখিয়েছেন অজয় বসু, পুষ্পেন সরকার ও কমল ভট্টাচার্য। কিন্তু তারও আগে রেডিওতে খেলার বাংলা ধারাভাষ্য যিনি শুরু করেছিলেন তিনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসের বেতারকেন্দ্র থেকে ‘কলকাতা বেতার’ প্রথম যাত্রা শুরু করে ১৯২৭ সালের ২৬ অগস্ট। ভারতীয় ও ইউরোপিয়, দুই বিভাগে অনুষ্ঠান ভাগ করা হয়েছিল। এর বছর তিনেক পর ভাবা হয় যে ফুটবলের সঙ্গে ধারাভাষ্য দেওয়া হবে। ১৯৩০ সালে মাঠ থেকে সরাসরি ফুটবল-ধারাবিবরণী সম্প্রচারের কথা প্রথম জানা যায়। শুরুটা হয়েছিল ইংরেজিতে। খেলার রিলে চালু হয়ে গেল ১৯৩০-এর ফুটবল-মরসুম থেকে। সেই সময়ে ধারাভাষ্য দিতেন বার্টি মায়ার, ডি ডব্লিউ সিডনি ফ্রিসকিন, নীরেন দে, বেরী সর্বাধিকারী, পিয়ার্সন সুরিটাররা। এঁরা ক্রীড়া-ধারাভাষ্যকার হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন।

কিন্তু বাংলায় তখনও ভরসা মাঠের চোঙা , ঢাক ঢোল, কখনও ঘুড়ি। ওর মাধ্যমেই খেলার ফলাফল জানা যেত। অল ইন্ডিয়া রেডিওর মাধ্যমে সেই রীতিতে পরিবর্তন এল। যদিও ব্রিটিশরা জানত , ফুটবল ভারতে বিদ্রোহের আর এক পথ। তারা ধারাভাষ্য হলে এই চেতনা আরও রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকবে মানুষের। সেদিকটা না ভেবে তাঁরা ব্যবসাটা দেখল। জাত বেনিয়া হলে যা হয় আর কি। তারা নজর দিল রেডিয়ো-সেটের বিক্রি এবং তার মাধ্যমে বেশি লাইসেন্স-ফি রোজগারের দিকে (আজকের কেবল ভাড়ার মতো প্রত্যেক বেতার-গ্রাহককে প্রতি মাসে লাইসেন্স-ফি দিতে হত)।

ইংরেজিতে ফুটবল-ধারাবিবরণীর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখে ‘ভারতীয়’ বিভাগের ডিরেক্টর নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদারের মনে হয় বাংলা ভাষাতেও এই ফুটবল-রিলে চালু করার কথা। কিন্তু এ কাজ করবে কে? ভাবা হয়েছিল রাজেন সেনগুপ্তের কথা, কারণ তিনি রেডিওতে প্রথম থেকেই কাজ করতেন ঘোষক ও সংবাদপাঠক হিসেবে। তিনি খেলাটাও ভালো বুঝতেন কারণ ১৯১১-য় শিল্ড জয়ী মোহনবাগানের সেন্টার-হাফ ছিলেন এই রাজেন সেনগুপ্তই। তিনি ছুটিতে। নাম ওঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের। সহকারী প্রখ্যাত সঙ্গীতকার তথা খেলা পাগল মানুষ রাইচাঁদ বড়াল। সেটা ১৯৩৪ সাল।দু’জনে গেলেন মাঠে। বেতারে প্রথম বার সেই বাংলা ধারাবিবরণী। ভদ্র এবং বড়াল দুজনেই এক্কেবারে ছড়িয়ে ‘ছ’ করেছিলেন। তবু চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না। এ কথা জানা যায় ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকায় তাঁর লেখা থেকেই।

ধারাবিবরণী দেওয়ার জায়গা থেকে বসে বীরেন ভদ্র বলা শুরু করলেন। বড়ালবাবু খেলা দেখেন বেশি , বলেন কম। খেলায় এক্কেবারে আনকোড়া ভদ্র পড়লেন মহা ঝামেলায়। সহকারী খেলা দেখায় মশগুল দেখে নিজেই বলে ফেলেন ‘ও রাই, বল না…’। ধারাভাষ্যের এমন হাল দেখে আশপাশে থাকা বিদেশি দর্শকরা হেসে কুটিকুটি খায়। চরম কেলেঙ্কারিটা করলেন বীরেনবাবুই। গোলকিপার হাত দিয়ে বল ধরেছে, দেখে তিনি চিৎকার করে উঠলেন ‘হ্যান্ডবল’ ‘হ্যান্ডবল’। এ হেন চিৎকারে সম্বিত ফেরে রাইচাঁদ বড়ালের। সবাই হাসছে।

বীরেনবাবু বুঝতে পারেন কিছু একটা যা তা হয়েছে , কিন্তু জানেন না কী যা তা হয়েছে। সহকারীকেই জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী হল রাই?’ রাইচাঁদবাবু বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘হল তোমার মুন্ডু! গোলকী হাতে ধরলে হ্যান্ডবল হয় রে গাধা?’ বেতারকেন্দ্রে পা দিয়েই নৃপেন মজুমদারের কাছে রাইচাঁদের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বলেছিলেন, ‘এরকম বুদ্ধিমান লোকদের আমার সঙ্গে পাঠাবেন না মশাই’। নৃপেন মজুমদার এসব শুনে আবার হেসে খুন। স্বাধীনতার আগে সেটাই প্রথম এবং শেষ বাংলায় খেলার কমেন্ট্রি।

এরপর ১৪ বছরের লম্বা সময়। বনবাস ও অজ্ঞাতবাস কাটিয়ে ১৯৪৮ সালে বেতারে ফেরে বাংলা ক্রীড়া-ধারাভাষ্য। সে বার চিনা ফুটবল দল কলকাতায় আসে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান ও আইএফএ একাদশের বিরুদ্ধে চারটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে। শুধুমাত্র ইস্টবেঙ্গল বনাম চিনা দলের ম্যাচটির বাংলা ধারাবিবরণী দেওয়া হয়েছিল। বাংলায় ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর খেলোয়াড় নির্মল চট্টোপাধ্যায়। খুব একটা ভালো হয়নি তবে কোনও হাস্যকর ঘটনাও ঘটেনি। তারপরে উন্নতি হয়েছে বাংলা ধারাভাষ্যের । সাম্প্রতিককালে মানস পল্লব জুটিতো সেরা। আজকাল আবার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ভাঙল ধারাভাষ্য শোনা যায়, যা উন্নতি যাত্রার প্রমাণ।