গাছের শুশ্রূষায় বাংলার রাজপথে “ট্রি অ্যাম্বুলেন্স”

ঈশানী মল্লিক: রোদের তীব্রতা দিনকে দিন যেভাবে বাড়ছে, এসি ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারছে না। কিন্তু রোজগারের তাগিদে মানুষকে রোদে বেরোতেই হচ্ছে। বারবারই পরিবেশবিদরা বলেছেন গাছ…

West Bengal's Cooch Behar to Launch First-Ever Tree Ambulance

ঈশানী মল্লিক: রোদের তীব্রতা দিনকে দিন যেভাবে বাড়ছে, এসি ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারছে না। কিন্তু রোজগারের তাগিদে মানুষকে রোদে বেরোতেই হচ্ছে। বারবারই পরিবেশবিদরা বলেছেন গাছ লাগানোর জন্য। “একটি গাছ একটি প্রাণ”-এই ধারণাও এখন অতীত হতে চলেছে। এখন “গাছ আরও গাছ” — এর পরিকল্পনা চলে এসেছে। বিশেষ করে সব মানুষকে একটি করে নিম গাছ লাগাতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এখন যে ভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে, তাতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে হাতে আর খুব বেশি সময় নেই বলেই জানিয়েছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। এই সময়ে শুধু নতুন গাছ লাগানো নয়, পুরোনো গাছেদের যত্ন এবং পরিচর্যাও সমান প্রয়োজন। আসলে, পরিবেশ রক্ষার জন্য একটি ছোট্ট পদক্ষেপকেও বিশেষভাবে স্বাগত জানাচ্ছে বিশ্ব।

সম্প্রতি বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস উপলক্ষে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চালু হয়েছে “গাছেদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা”! জানা যাচ্ছে, নানা সময়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে উপড়ে যায় বহু গাছ। কখনও আবার নির্মাণের কাজে বাধা তৈরির ‘অপরাধে’ নির্বিচারে কেটে ফেলা হয় গাছ। এই অ্যাম্বুল্যান্স রাস্তায় পড়ে থাকা ও কেটে ফেলা গাছ গুলো তুলে নিয়ে গিয়ে নতুন করে অন্য জায়গায় মাটিতে পোঁতার ব্যবস্থা করবে। এমনকি যে গাছ রুগ্ন হয়ে পড়েছে তার দেখভালের ব্যবস্থাও করবে এই অ্যাম্বুলেন্স।

   

এই পরিকল্পনা প্রথম এসেছিল পরিবেশ আন্দোলনকারী কে আব্দুল ঘানির মাথায়। ভারতের সবুজ মানুষ, “গ্রিন ম্যান অফ ইন্ডিয়া” বলে পরিচিত আব্দুল এখনও পর্যন্ত ভারতে চল্লিশ লক্ষ গাছ পুঁতেছেন। একটি বেসরকারি সংস্থার কাছে তিনি এই গাছের অ্যাম্বুলেন্সের প্রস্তাব রাখলে, তার সাদরে রাজি হয়ে এই কাজ শুরু করেন।
কিন্তু গাছেদের জন্য অ্যাম্বুল্যান্স বা “ট্রি অ্যাম্বুলেন্স” বিষয়টি ঠিক কী রকম! কী ভাবেই বা গাছ রক্ষার কাজ করবে এই যান। দেখে নেওয়া যাক…অ্যাম্বুলেন্স কি?

সম্পর্কিত:
ট্রি অ্যাম্বুলেন্স হল একটি উদ্যোগ যা ” পৃথিবীকে বাঁচানোর দৃষ্টিভঙ্গি” সহ ” গাছ বাঁচান” সমর্থন করার জন্য শুরু করা হয়েছে ।
ট্রি অ্যাম্বুলেন্সের প্রথম পর্বটি চেন্নাইতে জৈবিক বৈচিত্র্যের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস, ২০১৯ ( ২২ মে উদযাপিত ) উপলক্ষে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি দ্বারা ফ্ল্যাগ অফ এবং উদ্বোধন করা হয়েছিল ।
ট্রি অ্যাম্বুলেন্সগুলি উদ্ভিদবিদ, বন বিশেষজ্ঞ, উদ্যানপালক, স্বেচ্ছাসেবক এবং গাছের শল্যবিদদের দ্বারা পরিচালিত হয় এবং যারা অসুস্থ গাছ এবং গাছপালা উদ্ধারে সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে এর হেল্পলাইনে কল করে তাদের বিনামূল্যে পরিষেবা প্রদান করে।

লক্ষ্য:
ঘূর্ণিঝড় ভারদাহ এবং ঘূর্ণিঝড় গাজার কারণে উপড়ে যাওয়া গাছগুলিকে প্রতিস্থাপন করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই উদ্যোগটি চালু করা হয়েছিল।
ট্রি অ্যাম্বুলেন্সকে “প্রাথমিক চিকিৎসা, বীজ ব্যাংকিং, বীজ বল বিতরণ, উপড়ে ফেলা গাছ রোপণ, উদ্ভিদ বিতরণ, গাছ লাগানো, গাছ স্থানান্তর করা , এবং গাছের জরিপ করা এবং মৃত গাছ অপসারণ” এর মতো পরিষেবা প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ।

তাৎপর্য:
ট্রি অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা ভারত জুড়ে শুরু হচ্ছে , অসুস্থ গাছপালাকে আবার জীবিত করে তুলছে। কাজটি “শহুরে তাপ দ্বীপ” হ্রাস করে ভারতের শহরগুলিকে শীতল করতে সহায়তা করছে৷ জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও ভূমিকা রাখছে এসব ট্রি অ্যাম্বুলেন্স।

দেশের বিভিন্ন জায়গায় উপড়ে যাওয়া গাছকে নিয়ে গিয়ে অন্য জায়গায় লাগানোর পাশাপাশি, এই অ্যাম্বুল্যান্স বিভিন্ন জায়গায় বয়ে নিয়ে বেড়াবে নানা গাছের বীজ, সার, জল ইত্যাদি। এছাড়া এই অ্যাম্বুলেন্স সেই শহরের মানুষদের মধ্যে গাছ লাগানো-সংক্রান্ত সমস্ত রকম সচেতনতা ও গাছ লাগানোর বিষয়ে উৎসাহ দেবে। কোনও গাছ নষ্ট হয়ে গেলে, তার অংশগুলো সেখান থেকে তুলে

সঠিক জায়গায় পৌঁছেও দেবে এই যানবাহন।
অ্যাম্বুল্যান্সেই থাকবেন দক্ষ মালি ও গাছ-কর্মীরা। তাঁদের সঙ্গে থাকবে বাগান করার নানান জিনিসপত্র, সার, জল, ঝারি, খুরপি ইত্যাদি। এই প্রোজেক্টে বিশেষ ভাবে সহায়তাকারী বেসরকারি সংস্থা সাগা-র তরফে সুরেশকুমার যাদব বলেন- “একই সঙ্গে দূষণ বাড়ছে ও গাছের সংখ্যা কমছে। এই অবস্থায় বড় বড় প্রাপ্তবয়স্ক গাছগুলির মৃত্যু বোধহয় আমাদের পক্ষে মেনে নেওয়া মুশকিল। সে জন্যই, কোনও গাছ যাতে প্রাকৃতিক বা মানুষিক কারণে মারা না যায়, সেই কারণেই গাছগুলোকে রক্ষা করা ও মানুষের মধ্যে গাছ কাটার পরিবর্তে গাছ লাগানোর অনুপ্রেরণা ও সচেতনা বাড়াতেই এই গোটা উদ্যোগ এই উদ্যোগ এই সময়ে অত্যন্ত জরুরি বলে মনে হয়েছে আমাদের। যা যন্ত্রপাতি বা ওষুধপত্র দরকার, সে সবই আমরা রেখেছি অ্যাম্বুল্যান্সে। কোথাও থেকে গাছ তুলে এনে অন্য জায়গায় লাগানোর জন্যও অত্যাধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে।”

আবদুল ঘানি, এই অ্যাম্বুল্যান্স প্রকল্পের উদ্যোক্তা, বলেন, “কত গাছ ঝড়ে উপড়ে যায়। পড়ে পড়ে মারা যায় সেগুলি। নতুন করে লাগানোর ব্যবস্থা করাই হয় না। এই অ্যাম্বুল্যান্স আর তা হতে দেবে না। হেল্পলাইনে ফোন করা মাত্র আমরা অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে পৌঁছে যাব, বিনামূল্যে গাছটিকে সরিয়ে আনব।”

তিনি আরও বলেন, “শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে উপড়ে যাওয়াই নয়। অনেক সময়েই দেখা যায়, গাছের কারণে সমস্যায় পড়ছেন পথচারী বা শহরবাসীরা। সেগুলি কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। আমাদের জানালে আর এভাবে মারতে হবে না গাছগুলিকে। যত্ন করে তাদের সরিয়ে অন্যত্র বসাব আমরা। পশ্চিমবঙ্গে প্রথম কোচবিহারের একটি কারখানায় তৈরি হচ্ছে “ট্রি অ্যাম্বুল্যান্স”।

অত্যাধুনিক অ্যাম্বুল্যান্স। সেই অ্যাম্বুল্যান্স তৈরি করা হচ্ছে কোচবিহারের একটি গ্যারাজে। তাতে থাকবে ২৬ রকমের যন্ত্রপাতি। তবে সেসব যন্ত্র অসুস্থ মানুষের কোনও কাজে লাগবে না। তা দিয়ে পরিচর্যা হবে শুধুমাত্র গাছের। উত্তরবঙ্গে প্রথম ‘ট্রি অ্যাম্বুল্যান্স’ চালু করতে চলেছে কোচবিহারের ‘পর্যাবরণ সংরক্ষণ’ নামে একটি পরিবেশপ্রেমী সংস্থা।

দিনকয়েকের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে পরিষেবা শুরু হবে। কোথাও গাছ ‘বিপদে’ পড়লে ঘটনাস্থলে যাবে সেই অ্যাম্বুল্যান্সটি। ঝড়ে পড়ে যাওয়াই হোক কিংবা পরিচর্যার অভাবে ধুঁকতে থাকা গাছ, অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে গিয়ে সেই গাছের শুশ্রূষা করা হবে। এই সংগঠনের অন্যতম কর্মকর্তা বিনয় দাস বলেছেন, ‘অনেকেই গাছ রোপণ করেন, কিন্তু পরবর্তীতে আর খোঁজখবর রাখেন না। আমরা বছরে চার মাস বৃক্ষরোপণ করি। আট মাস সেই গাছগুলিই পরিচর্যা করি। অ্যাম্বুল্যান্স কয়েকদিনের মধ্যেই চালু হবে। তখন আরও দ্রুত গাছের পরিচর্যা করা সম্ভব হবে। এখানে আমরাই প্রথম এই উদ্যোগ নিচ্ছি।’

২০১৯ সাল থেকে কোচবিহারে ‘পর্যাবরণ সংরক্ষণ’ নামে এই সংগঠনটি কাজ করছে। এবার তাদের কর্মকাণ্ডে নতুন সংযোজন “ট্রি অ্যাম্বুল্যান্স”। কী কী থাকবে এখানে? সংগঠনের তরফে জানানো হয়েছে, গাছের চারা রোপণের জন্য অত্যাধুনিক ড্রিল মেশিন থাকবে। এই মেশিনটি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাটিতে গাছ রোপণের জন্য গর্ত খুঁড়ে দেবে। এছাড়াও ইলেক্ট্রিক কাটার, কোদাল, দা, গাছ ঘেরাওয়ের জাল সহ গাছ পরিচর্যার বহু সামগ্রী থাকবে। ঝড়ে বহু জায়গাতেই গাছ উপড়ে পড়ে যায়। কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিচর্যা করলে সেগুলি বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু তার পরিবর্তে সেগুলি কেটে ফেলা হয়। এখন থেকে সেই গাছগুলির পরিচর্যা করবেন তাঁরা। নির্মাণকাজের সময় অনেক ক্ষেত্রেই গাছপালা কেটে ফেলা হয়। ছোট ও মাঝারি গাছগুলি যেগুলি প্রতিস্থাপন করার মতো সেগুলি অন্যত্র রোপণ করবেন তাঁরা।

এই কাজের জন্য প্রায় ৫০ জন সদস্য রয়েছেন। কোচবিহারে তারা পাঁচটি খণ্ডবন তৈরি করেছেন। বিসর্জন ঘাটের খণ্ডবনে প্রায় ২০ বিঘা জায়গায় আম, জাম, কাঁঠাল, বট, পাকুর গাছ লাগানো হয়েছে। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন রাস্তার ধারে নিয়মিত গাছ লাগান তাঁরা। পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্যকেও এই সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে গাছ লাগাতে দেখা যায়।

দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি উদ্যোগে “ট্রি অ্যাম্বুল্যান্স” চালুর দাবি ছিল। সরকারিভাবে না হলেও পরিবেশপ্রেমী সংস্থার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে অন্য সংগঠনগুলিও।