ফাইনালের আগে চন্দননগর মেতেছে এমবাপ্পে পুজোয়

চন্দননগরে আজকে ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনার ফাইনাল ম্যাচে ফ্রান্স (France ) এর বিশ্বকাপ জয়ের জন্যে জোর-তোর চলছে এমবাপ্পের পুতুলে পুজো ও যজ্ঞের মাধ্যমে। সারা ভারতে যখন…

doing puja of embappe

চন্দননগরে আজকে ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনার ফাইনাল ম্যাচে ফ্রান্স (France ) এর বিশ্বকাপ জয়ের জন্যে জোর-তোর চলছে এমবাপ্পের পুতুলে পুজো ও যজ্ঞের মাধ্যমে। সারা ভারতে যখন মেসি বন্দনা চলছে। আর্জেন্টিনা স্তুতির মাঝে বাংলার এই স্থান মেতেছে লাতিন শিল্প ভুলে ইউরোপীয় দৌড়ে। প্রার্থনা হচ্ছে ফ্রান্সের জন্য। পূজো হচ্ছে কিলিয়ান এমবাপ্পেদের। হওয়াটাই স্বাভাবিক। ফরাসি কলোনি থেকে এই স্থান মুক্ত হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার পর।

সময় টা তখন সপ্তদশশতাব্দী, আনুমানিক১৬৭৩ সাল । মঁসিয়ে দুপ্লেসিসের নেতৃত্বে ফরাসীরা পা রাখে চন্দননগরে । একটি গুদামঘর তৈরি করে তিনি এখানে ১৬৭৬ সাল পর্যন্ত থাকলেও কোনো উন্নতি করতে পারেন নি। বাঁশবেড়িয়া-শেওড়াফুলি জমিদার অধিকৃত হুগলি চাকলার মুহম্মদ-আমিনপুরের অন্তর্গত ছিল এ চন্দননগর। ১৬৮৮ সালের এক ফরমানের বলে ফরাসিরা গৌরহাটিতে একটি কুঠি নির্মাণ করে। ১৬৯৭ সালে ডেসল্যান্ড বর্তমান লালদিঘির কাছে ‘ডি-অঁরলিয়ে’ দুর্গ নির্মাণ করেন, যা ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায়। ১৭৩৬ সালে পন্ডিচেরির গভর্নর দিসা স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা প্রকাশের জন্য নওয়াবের কাছ থেকে ফরমান সংগ্রহ করেন। ১৭৩১ সালে নতুন গভর্নর, জোসেফ ফ্রান্সিস ডুপ্লে জমিদারদের কাছ থেকে জমি নিয়ে উত্তরে তালডাঙ্গা থেকে দক্ষিণে গৌরহাটি পর্যন্ত শহরটিকে প্রসারিত করেন।

এ শহরের শাসন ব্যবস্থা একজন গভর্নর ডাইরেক্টর, ৫ জন সদস্যের দ্বারা গঠিত কাউন্সিলের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। এ ছাড়াও এ কাউন্সিলে ১৫ জন ব্যবসায়ী, ২ জন ডাক্তার, একজন দক্ষ কারিগর, ২ জন পাদ্রি এবং ২০ জন ভারতীয়সহ ১০৩ জন সৈনিক ছিলেন। ১৯০৯ সালে এখানে ইট নির্মিত গৃহ ছিল ২০০০টি, ও জনসংখ্যা ছিল ২৬,৮৩১। ইউরোপীয় অঞ্চলে একটি সুন্দর মঠ, দুর্গ, নদীবন্দর, গভর্নরের বাসভবন, থিসল হোটেল, ১৭২৬ সালে নির্মিত সেন্ট লুই চার্চ, গৌরহাটিতে এক মনোরম প্রাসাদ এবং নদী তীরবর্তী বাঁধানো প্রশস্ত ভ্রমণ পথ ছিল। পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে ১৭৫৭ সালে মীরজাফর যুদ্ধক্ষেত্রে সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে কিনা তা নিশ্চিত করতে রবার্ট ক্লাইভ এখানে থেমেছিলেন।

আজকে চন্দননগরে যেটি কুঠির মাঠ হিসাবে খ্যাত একদা সেটি ছিল এই দুর্গের অংশ ।১৭৫৭ খৃঃ ইংরাজ ও ফরাসীদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় , এর ফলস্বরূপ চন্দননগর ইংরাজদের দখলে আসে ।১৮ ই মার্চ লর্ডক্লাইভ স্থলপথে এবং ওয়াটসন জলপথে আক্রমণ করে ,ইংরাজদের ঘন ঘন গোলাবর্ষনে ভেঙ্গে পড়ে ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরী নির্মিত অন্যতমঐতিহাসিক স্থাপত্য নন্দদুলাল মন্দিরের একাংশ । ২৩শে মার্চ ইংরাজ আর্লিয়া দুর্গ দখল করে । ১৭৫৭ থেকে ১৮১৬ পর্যন্ত মোট চারবার চন্দননগরের বুকে উড়েছিল বৃটিশ পতাকা । মূলতঃ মসিয়ে দুপ্লের শাসনকাল ই ছিল চন্দননগরে ফরাসী শাসনের স্বর্ণযুগ । ফরাসী জেনারেল দি রোঁয়ার নেতৃত্বে চন্দননগর প্রথম গড়বন্দী হওয়ার পরিকল্পনা গৃহিত হয় । এরপর ১৮১৬ থেকে চন্দনগরে আসে সম্পূর্ন ফরাসী নিয়ন্ত্রন । ধিরে ধিরে এই ফরাসডঙ্গি এক মনোরম নগরী হিসাবে রূপলাভ করে ।

প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট । আজ যেটি ফ্রেঞ্চ ইন্সটিটিউট রূপে খ্যাত সেটি একদা দুপ্লের বাসভবন ছিল ।১৮৫০ খৃঃ নির্মিত হয় স্ট্র্যান্ডের ধারে সু উচ্চ ক্লক টাওয়ার । ১৮৭০ সালে নির্মিত হয় হোটেল দি প্যারিস যা আজকের সাবডিভিসনাল জুডিসিয়াল কোর্ট। এরপর ১৮৭৫ খৃঃ তৈরী হয় রোমান ক্যাথিলিক গির্জা যা আজো ফরাসী স্থাপত্যের সাক্ষ্য বহন করছে । চন্দননগরের লিবার্টি গেট যা আজো সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতার ঐতিহ্য বহন করছে । ঐতিহ্যশালী দুপ্লে কলেজ আজ চন্দননগর সরকারী কলেজ হিসাবে খ্যাত । ফরাসী স্থাপত্যের পাশাপাশি বহু ধনী ব্যাক্তিবর্গ বিভিন্ন সুউচ্চ সুন্দর মহল নির্মান করেন এদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী দুর্গাচরন রক্ষিত নির্মিত রক্ষিত ভবন ও রক্ষিত স্কুল বা একল দুর্গা অন্যতম ।

এছড়াও চন্দননগরের অন্যতম শিক্ষাব্রতী হরিহর শেঠের বসত বাড়ী শেঠ বাড়ি ও তার নির্মিত মেয়েদের স্কুল কৃষ্ণভাবিনী নারীশিক্ষা মন্দির ও চন্দননগর পাঠাগার নৃত্যগোপাল স্মৃতি মন্দির অন্যতম । এছড়াও চন্দননগরের গোন্দলপাড়ার মন্ডলবাড়ীতে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গীর কবিগানের আসর বসত । উর্দিবাজারের শেখ হার্বেন এর তৈরী মসজিদ হল অন্যতম একটি স্থাপত্য কির্তির নিদর্শন ।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে চন্দননগর হল মুক্তি পথের অগ্রদূত ।আলিপুর বোমার মামলায় অভিযুক্ত হয়ে অরবিন্দ ঘোষ ও অন্যান্য বিপ্লবী এখানে আশ্রয় নেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের কর্মীরা, বিপ্লবী গনেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, শহীদ জীবন ঘোষালরাও এখানে আত্মগোপন করে ছিলেন একসময়। ফরাসি উপনিবেশ, তাই ব্রিটিশ পুলিশকে অনুমতি নিয়ে এখানে ঢুকতে হতো। সেই সুযোগে বিপ্লবীরা পালাতেন। শহীদ কানাইলাল বসুর শৈশব কেটেছে এই শহরে। তাঁর ভিটে, নামাঙ্কিত একটি বিদ্যালয় ও ক্রীড়াঙ্গন এই শহরে রয়েছে। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পৈতৃক ভিটে এই শহরে ফটোকগোড়া এলাকায়। হুগলী নদির তীরে গড়ে ওঠা চন্দননগর শহরের স্ট্র্যান্ড আজো ফরাসী স্থাপত্যের বার্তা বহন করে । এখানেই অবস্থিত পাতাল বাড়িতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীর্ঘ্যদিন অবস্থান করেন ।এছাড়াও তৎকালীন জাহ্নবী নিবাস বা আজকের রবীন্দ্রভবনে দুশোতম সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।

১৯৪৯ সাল চন্দননগরে গনভোট হল ।১৯৫০এর ২রা মে ফরাসী শাসন থেকে মুক্ত হল চন্দননগর । ১৯৫৪ফরাসডঙ্গী বা চন্দননগর পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত হল । সময় চির প্রবাহমান কিন্তু চন্দননগর আছে চন্দননগরেই। এমন স্থানে এমবাপ্পেদের পূজো হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।