Heritage Durga Puja: কাশির ঠাটারিবাজারের কাছেই চৌখাম্বার বসু পরিবার। সেই বাড়িতেই একসময় মহাধুমধাম করে দুর্গোৎসব হতো। এই বাড়ির উঠোনে আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে এক সুদৃঢ় বালকের পা পড়তো। তখন কে জানত যে সেই বালক হবেন আগামীর দেশনায়ক। কালের গহ্বরে আজ সবই গিয়েছে হারিয়ে।
উত্তর কলকাতা দত্ত বাড়ির ছয় মেয়ে। প্রভাবতী, গুনবতী, রূপবতী ,সত্যবতী, ঊষাবতী এবং নিশাবতী। প্রভাবতীর বিয়ে হয় কটকের জানকীনাথ বসুর সঙ্গে। রূপবতীর বিয়ে হয় উপেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে। নিয়তির খেলায় মারা যান রূপবতী। রেখে যান সন্তানদের। তাদের সামলাবে কে? সেই সময়ের রীতি মেনে দিদির সংসার রক্ষায় এগিয়ে আসেন ঊষাবতী। দুই মাসির বিয়ে একই বাড়িতে। সেই সূত্রেই গাঁথা হয়ে গিয়েছিল সুভাষের সঙ্গে এই বসু পরিবারের যোগ। সেই বাড়িতেই একসময় মহাধুমধামে হতো দুর্গোৎসব।
বিশাল বড় ঠাকুরদালান থেকে শুরু করে সিংহাসনে দেবী মূর্তি সঙ্গে ঢাক ঢোল বাদ্যির বিশাল আয়োজন ছিল। প্রকাণ্ড এক রুপোর পাত বসানো কাঠের সিংহাসন। এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতেন মহিষাসুরমর্দিনী, তার বামদিকে দেবী সরস্বতী ,কুমার কার্তিক, হনুমান ও শ্রীরামচন্দ্র এবং নারায়ন শিলা। ডানদিকে দেবী লক্ষী, সিদ্ধিদাতা গণেশ, মহাদেবের মূর্তি এবং আরেকটি ছোট ধাতুর ছোট সিংহাসন। মায়ের গায়ের রং সোনালী, গা ভরতি সোনার গয়না, অশ্বরূপী সিংহ এবং সিংহাসন এর সামনে ২ টি লম্ফ।সব মিলিয়ে এক বিশাল আয়োজন হত।
সেই বাড়ির এক জ্ঞাতি রণবিজয় বসু জানিয়েছেন , “আমি ওই বাড়ির পুজো দেখতে গিয়েছিলাম ১৯৯৯ সালে। আসলে আমার মায়ের দাদুর মা ছিলেন ঊষাবতী দেবী, যিনি নেতাজির মাসি। সেই সূত্রেই ওই বাড়ির পুজোয় গিয়েছিলাম। সেই স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল।”
তিনি বলেন, “সন্ধ্যা আরতির দৃশ্য আজও স্পষ্ট। প্রত্যেক ভগবানকে উৎসর্গ করে সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো এক একটি আসন। প্রতিটি লাল কাপড়ে মোড়া। আসনের পিছনে একটি করে রুপোর গারু ও বাটি আসনের সামনে রুপোর থালা। তাতে সাজানো ছিল ফল, বরফি, নানাবিধ খাদ্যসামগ্রী। ধূপ , ধুনোর গন্ধে ভরে উঠত সারা চত্বর।”
দশমীর দৃশ্য ছিল দেখার মতো। সবকটি মূর্তিকে সিংহাসন থেকে বার করে আনা হত। প্রমাণ আকারের দুইটি রুপোর পেট মোড়া বল্লম ঠাকুরদালানে থামে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো থাকত। সেগুলো বিসর্জনের সময় বহন করতেন বাড়ির সদস্যরাই। আসলে বাড়ির মেয়েকে বাড়ি পাঠানোর জন্য সুরক্ষা বলয় তৈরি করা। বসত নহবত। পরে আসত ব্যান্ড পার্টি, ট্রাম্পেট, বিউগেল, ড্রাম, ঝুনঝুনি, সঙ্গে সানাই। সামনাসামনি না দেখলে ভাষায় বোঝানো মুশকিল সেই দৃশ্য। এরপর লাল কাপড়ে মোড়া সাজানো পালকি এসে হাজির হতো উঠোনে। এক এক করে মূর্তিগুলি পালকিতে ঢুকিয়ে এমনভাবে বসানো হত যেন মা ও তাঁর সন্তানরা পালকির ভিতরে আরাম করে হেলান দিয়ে বসলেন। এরপর শুরু হত বিসর্জন যাত্রা। প্রথমে বল্লমধারিরা, তারপর ব্যান্ড পার্টি, তারপর পালকিবাহক এবং সব শেষে অগুনতি মানুষের ঢল। ঠাকুর এসে থামত দশাশ্বমেধ ঘাটে। তখনও ওড়ানো হল একজোড়া নীলকন্ঠ পাখি। সাত পাক করে ঘুরিয়ে বিসর্জন। সবাই চেঁচিয়ে বলতেন শুভ বিজয়া।কথিত রয়েছে এই বাড়িতে সুভাষ বোস কিছুদিন ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়ে থেকেওছিলেন।
২০০০ সালের পরেও বেশ কিছু বছর এভাবেই চলেছে পুজো। তারপর আর কিছুই রক্ষা করা যায়নি। বাড়ি ক্রম অবনতি হওয়ার ফলে ভেঙে পড়ছিল। বাড়িই রাখা দায়, তো পুজো। সে সবকিছুই এখন হারিয়ে গিয়েছে। সুভাষ স্মৃতির সঙ্গে হারিয়েছে শিউলির সুবাস…