জেলের অন্ধকার কুঠুরি আর মারণ রোগকে সঙ্গে নিয়েই লড়াই শুরু হয়েছিল গণনাট্যের কারিগরের

জেলের অন্ধকারে বসে আছেন এক তরুণ। রোগা চেহারাটা এই কদিনে আরও শুকিয়ে এসেছে। ক্রমাগত কেশে চলেছেন তিনি। পুরো করিডোর ভরে গেছে সেই আওয়াজে। কাশি, আর…

hemanga biswas

জেলের অন্ধকারে বসে আছেন এক তরুণ। রোগা চেহারাটা এই কদিনে আরও শুকিয়ে এসেছে। ক্রমাগত কেশে চলেছেন তিনি। পুরো করিডোর ভরে গেছে সেই আওয়াজে। কাশি, আর সেই সঙ্গে বেরিয়ে আসছে রক্ত। জেলের চিকিৎসকরা জানালেন, যক্ষ্মা হয়েছে এই তরুণের। তাহলে বোধহয় আর বাঁচবেন না। আর এমন পরিস্থিতিতে ইংরেজরাও আরও শক্ত হয়ে উঠল। সাহেবরা একদিন হাজির হল ওই কারাগারে। তরুণটির সামনে দিলেন একটি সাদা কাগজ। এই অবস্থায় বাড়ি ফিরে যাওয়াই উচিত তাঁর। তবে আর কোনদিন স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হবেন না, স্বদেশি গান গাইবেন না— এমন কথা ওই সাদা কাগজে লিখে দিলে ইংরেজরা ছেড়ে দেবেন তাঁকে। কাশতে কাশতেই ইংরেজদের দিকে তাকালেন ওই তরুণ— হেমাঙ্গ বিশ্বাস। অবজ্ঞার হাসি ফুটে উঠল শীর্ণ ঠোঁটে। এমন কাজ করার থেকে কারাগারের অন্ধকারে থাকাই ভালো তাঁর…

অবশ্য বেশিদিন তাঁকে থাকতে হয়নি। ইংরেজরা ভেবেছিলেন, এই ছেলের আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। মারণরোগ হিসেবে এমনিতেই যক্ষ্মার দুর্নাম ছিল তখন। কিন্তু ওঁর নাম যে হেমাঙ্গ বিশ্বাস। এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে বাংলা, ভারতের গণনাট্যের ছবিটা কে তুলে ধরবে? কে মানুষের মধ্যে জাগিয়ে দেবে মাটির চেতনা? শুধু কি গণসঙ্গীত? লোকসঙ্গীতও তো আঁকড়ে ধরেছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। তবে চিরাচরিত গানের ধারা নয়, সেইখানেও ছিল নিজস্বতা। অনেক সময় লোকগানের সুর নিয়ে তৈরি করেছেন নিজের গান। এইভাবেই ছড়িয়ে পড়েছিলেন গ্রামে-গঞ্জে, পাড়ায়, শহরে। সঙ্গী ছিল লাঙ্গল, কাস্তে নিয়ে ময়লা জামা পরে মাঠে নামা গরিব কৃষক-মজুররা…

   

বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছে এক বছর হল। ১৯১২ সাল। সিলেটের মিরাশী গ্রামে জন্ম নিল ফুটফুটে এক ছেলে। জমিদার পিতা, বাড়িতে কোনো অভাব নেই। গান বাজনা, সংস্কৃতি এসব থেকে শতহস্ত দূরে তিনি। আর তাঁরই ছেলে হয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বেছে নিলেন সেই গানকেই। জমিদার পরিবারের ‘নীল রক্ত’-এর গণ্ডি ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন মাঠে-ঘাটে। দেখলেন বাংলার জনগণকে। সময়টাও ছিল আগুন জ্বলার। ব্রিটিশ শাসনে অতিষ্ঠ গোটা দেশ। মুক্তির আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সব স্তরে। কচ্ছ থেকে খুলনা, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী — মানুষ আর চুপ করে নেই। এমন ঝড়েই বেড়ে উঠেছিলেন হেমাঙ্গ। সদ্য মেট্রিক পাশ করে কলেজে ঢুকেছেন তিনি। এমন সময় স্বাধীনতার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন। এরপর, কারাবাস এবং কলেজ থেকে বহিষ্কার। কারাবরণের যাত্রা শুরু হয়েছিল এই সময় থেকেই।

hemanga biswas

গোটা বিশ্বে ততদিনে নতুন ঢেউ নিয়ে এসেছে সোভিয়েত রাশিয়া। বামপন্থা, কমিউনিজমের হাওয়া ছড়িয়ে পড়ছে নানা জায়গায়। ভারতেও তার ঢেউ এসে লাগল। তরুণ হেমাঙ্গের ভেতরেও ঝড় তুলল সেই বাণী। দেশকে বুঝতে গেলে দেশের মানুষদেরও তো বোঝা দরকার। কৃষক, শ্রমিকদের মাটি-কালি মাখা ময়লা হাতই যে মূল ভিত্তি, সেটা যেন একটু একটু করে বুঝতে পারছিলেন তিনি। বুঝতে পারছিলেন তাঁর মতো আরও বহু তরুণ। যোগ দিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। এদিকে ছেলে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বিপ্লব করছে, গান-নাটক-কবিতা নিয়ে আছে সেটা মেনে নিতে পারলেন না জমিদার বাবা। হয় গান থাকবে, নয়তো পরিবার। রাস্তা বেছে নিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। বাড়ি ছাড়লেন তিনি, বরাবরের মতো।

ক্রমশ চল্লিশের দশকের দিকে গড়িয়ে যেতে লাগল সময়। একটু একটু করে মঞ্চে আসছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস, দেবব্রত বিশ্বাস, সলিল চৌধুরীরা। রবীন্দ্রসঙ্গীত, লোকসঙ্গীতের পাশাপাশি আরও এক নতুন ধারার গানের জন্ম হল। গণসঙ্গীত। আর এই পুরো চিত্রনাট্যের মূল মঞ্চ হয়ে উঠল আইপিটিএ, ভারতীয় গণনাট্য। একেবারে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যার অন্যতম স্তম্ভ হয়ে উঠলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। ছাতার তলায় হাজির হলেন দেবব্রত বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটক, বিনয় রায়, নিরঞ্জন সেনরা। ভারতের ও বাংলার সংস্কৃতির ইতিহাসে শুরু হল নতুন অধ্যায়। এরপর আসাম এবং সিলেটেও গণনাট্য সঙ্ঘ তৈরি করলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। ‘তোমার কাস্তেটারে দিও জোরে শান’, ‘কিষাণ ভাই তোর সোনার ধানে বর্গি’ এই গানগুলো তো কিংবদন্তি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সেইসঙ্গে ছিল চল্লিশের দশকের শেষে লেখা ‘মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য’। ‘স্যাটায়ার’ বা ব্যঙ্গাত্মক এই মঙ্গলকাব্য একটা সময় মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল।

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথা বললে আরও দুজন মানুষকে নিয়ে আসতে হয়। প্রথমজন, দেবব্রত বিশ্বাস। দুজনেই রবীন্দ্রভক্ত, ওপার বাংলা থেকে এসেছেন; আর দুজনকেই মিলিয়ে দিয়েছিল গণনাট্য। প্রিয় ‘হেমাঙ্গ’-কে কেবল ভালোবাসতেনই নয়, শ্রদ্ধাও করতেন। এই দুজন আড্ডায় বসলে গান আসবে না, তা কি হয়? জর্জের সামনে রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে হেমাঙ্গকে দমিয়ে দিতেন তিনি। সটান বলে দিতেন ‘তুমার রবীন্দ্রসঙ্গীতটা হইব না, ছাইড়া দাও।’ কিন্তু কেন? সিলেটি উচ্চারণে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া যায় না। এমন উত্তর শুনে হেমাঙ্গবাবুর কী উত্তর ছিল, জানা যায়নি। কিন্তু পারস্পরিক শ্রদ্ধার জায়গাটা নড়বড়ে হয়নি এতটুকুও।

আর ছিলেন আরেক ‘বাঙাল’, ঋত্বিক ঘটক। দুজনের পরিচয়ও খুব অদ্ভুতভাবে। গণনাট্যে তো আলাপ পরিচয় ছিলই। পরে যখন কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল, পার্টির কর্মী-নেতাদের গ্রেফতার করা শুরু হল; তখন হেমাঙ্গ বিশ্বাস লুকিয়ে আসাম থেকে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। তখনই আলাপ আরও দৃঢ় হয় দুজনের। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সুর, তাঁর কথা, গানের চলন সবকিছু নিয়েই মুগ্ধ ছিলেন ‘ভবা’। চেয়েছিলেন, হেমাঙ্গ যেন তাঁর ছবিতে গান গায়। ‘নাগরিক’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় চেষ্টা করলেন বটে; কিন্তু হেমাঙ্গ বিশ্বাস রাজি হননি। তিনবারের সময় একেবারে নাছোড়বান্দা হয়ে গেলেন ঋত্বিক। উপায় না দেখে রাজি হলেন হেমাঙ্গ। ‘কোমলগান্ধার’ সিনেমা সাক্ষী থাকল তাঁর গানে। পরবর্তীকালে ঋত্বিক ঘটক যখন গোবরা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হলেন, তখন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বাড়ি থেকেই খাবার যেত তাঁর। নিজেও যেতেন অনেক সময়। ঋত্বিকের অনুরোধে সেই মানসিক হাসপাতালের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গানও গান হেমাঙ্গ। ততদিনে তিনি চাকরি করছেন ‘সোভিয়েত দেশ’ পত্রিকায়। পার্টির তরফ থেকে ঘুরে এসেছেন চিন থেকেও। মতের অমিল হওয়ায় একসময় সেই চাকরিও ছেড়ে দেন অক্লেশে…

শারীরিক অসুস্থতা, অভাব— সবকিছুর মধ্যেও দুটো জিনিস কখনও ছাড়েননি তিনি। এক, নিজের আদর্শ; দুই, গান। নকশাল আন্দোলনের পর ১৯৭১ সালে তৈরি করেন একটি গানের দল, নাম ‘মাস সিঙ্গার’। গোটা জায়গা ঘুরে বেরিয়েছেন তিনি এই দলের সঙ্গে। মানুষের কথা, মানুষের গান পৌঁছে দিয়েছেন মাটির কাছে। কেবল শিল্প সৃষ্টি করতে হবে বলে করেননি; গান-নাটক-কবিতাকে অস্ত্র করে নিয়েছিলেন। নকশালবাড়ির আন্দোলনের সময় একের পর এক নাটকে, গানে, লেখায় নিজের সমর্থন জানিয়েছেন তিনি। বহুবার কারাবরণ করেছেন, অত্যাচারিত হয়েছেন। তথাকথিত সমাজ তাঁকে স্বীকৃতি দেয়নি, তাতে কি হয়েছে। মেরুদণ্ড না বিকিয়ে কাজটুকু তো করেছেন। তিনি যে হেমাঙ্গ বিশ্বাস। মচকাতেও জানেন না, ভাঙতেও জানেন না।