স্বামীজীর বাণী বদলে দিয়েছিল মাতঙ্গিনীর জীবন

বিশেষ প্রতিবেদন: তিনি গান্ধী বুড়ি। ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। সেই তাঁকেই স্বামীজীর বাণী ব্যাপকভাবে স্পর্শ করেছিল। তাই তো ইংরেজদের করা তিনটে গুলির শেষটি চোখ, খুলি…

matangini hazra

বিশেষ প্রতিবেদন: তিনি গান্ধী বুড়ি। ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। সেই তাঁকেই স্বামীজীর বাণী ব্যাপকভাবে স্পর্শ করেছিল। তাই তো ইংরেজদের করা তিনটে গুলির শেষটি চোখ, খুলি ফাটিয়ে বেরিয়ে গেলেও তাঁর হাত থেকে পড়েনি জাতীয় পতাকা। তিনি যে দেশ মায়ের একনিষ্ঠ সেবিকা হয়ে গিয়েছিলেন।

স্বামীজি বলেছিলেন, “এখন থেকে আগামী পঞ্চাশ বছর তোমাদের একমাত্র উপাস্য দেবতা হবেন – জননী-জন্মভূমি। তার পূজো করো সকলে”। ভারতবাসীদের উদ্দেশ্যে বলা স্বামী বিবেকানন্দর একটি বাণী ওই সময়ে মাতঙ্গিনীকে বিশেষভাবে স্পর্শ করেছিল। তারপরে যা হয়েছে তা ইতিহাস।

   

তাঁর জন্ম ১৮৭০ সালের ১৯ অক্টোবর। পশ্চিমবঙ্গের তমলুকের হোগলায়। সাধারণ এক কৃষক ঠাকুরদাস মাইতির ঘরে। অল্প বয়সেই তার বিয়ে হয় আলিনান গ্রামের ত্রিলোচন হাজরার সঙ্গে। ১৮ বছর বয়সেই স্বামীকে হারান মাতঙ্গিনী হাজরা। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। আদতে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিতা। প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষাদীক্ষা তেমন ছিল না। ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর একনিষ্ঠ অনুসারী। সেইজন্য তাঁর আরেক পরিচয় গড়ে উঠেছিল ‘গান্ধীবুড়ি’ নামে। গান্ধীর আদর্শমতে, তিনি নিজের হাতে চরকা কেটে খাদি কাপড়ও বানিয়েছেন।

১৯০৫ সালে ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯২২ সালের অসহযোগ আন্দোলনেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। তার বিপ্লবী জীবন ছিল ক্ষুরধার। ব্রিটিশের লবণনীতির প্রতিবাদে তার লড়াই ছিল দুরন্ত। তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসেরও সদস্য ছিলেন। ডান্ডি অভিযান, অসহযোগ আন্দোলন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন কিংবদন্তীতুল্য।

ত্রিশের দশক। মেদিনীপুরের নাম শুনলেই সেই সময় বিদেশী শাসককুল আতঙ্কিত ও দিশেহারা হয়ে পড়ত। আইন অমান্য আন্দোলনে মাতঙ্গিনী ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। খবর পেয়েই পুলিশ এল। মাতঙ্গিনী গ্রেফতার হলেন। সঙ্গে রইলেন অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকরাও। তাঁরাও গ্রেফতার হলেন।

matangini hazra

পরবর্তী ঘটনা ঘটে ১৯৩৪-৩৫ সালের। অবিভক্ত বাংলার লাটসাহেব মি. অ্যান্ডারসন তমলুকে দরবার করবেন। কিন্তু মেদিনীপুরবাসীরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ লাটসাহেবকে এই দরবার তারা কিছুতেই করতে দেবে না। এদিকে ইংরেজ সরকারও তাঁদের সংকল্পে অটল। ফল, সংঘাত।

লাটসাহেবের দরবার বসার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। এমন সময় হাজার কণ্ঠে ধ্বনি উঠল ‘লাটসাহেব তুমি ফিরে যাও- ফিরে যাও।’ বন্দে মাতরম ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল আকাশ বাতাস।

শোভাযাত্রা এগিয়ে চলল দরবারের দিকে। শত শত পুলিশও হাজির। হাতে তাঁদের লাঠি ও বন্দুক। শোভাযাত্রীদের পথ আটকাল ওই পুলিশবাহিনী। পুরোভাগেই ছিলেন মাতঙ্গিনী। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করল। এবার কিন্তু তাঁকে আর এমনিতে ছেড়ে দেওয়া হল না। রীতিমতো বিচার হল। মাতঙ্গিনী দুমাস সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। বিচারের রায় ঘোষণার পর হাসিমুখে বললেন, “দেশের জন্য, দেশকে ভালোবাসার জন্য দণ্ডভোগ করার চেয়ে বড় গৌরব আর কী আছে?”

মাতঙ্গিনীকে অমর করে রেখেছে ১৯৪২ সালের আগস্ট বিপ্লব। ঘটনা ২৯ সেপ্টেম্বর আজকের দিনের, কিন্তু ৭৯ বছর আগের। আগস্ট বিপ্লবের জোয়ার তখন মেদিনীপুরে আছড়ে পড়েছে। ঠিক হয়েছে এক সঙ্গে তমলুক, মহিষাদল, সুতাহাটা ও নন্দীগ্রাম থানা আক্রমণ করে দখল করে নেওয়া হবে।

মাতঙ্গিনী স্বেচ্ছাসেবকদের বোঝালেন গাছ কেটে ফেলে রাস্তা-ঘাট সব বন্ধ করে দিতে হবে। টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের তার কেটে দিতে হবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে হবে। পাঁচদিক থেকে পাঁচটি শোভাযাত্রা নিয়ে গিয়ে তমলুক থানা এবং একই সঙ্গে সমস্ত সরকারি অফিস দখল করে নিতে হবে।

যেমন কথা তেমনি কাজ। ২৯ সেপ্টেম্বর পাঁচটি দিক থেকে পাঁচটি শোভাযাত্রা এগিয়ে চলল তমলুক অধিকার করতে। হাজার হাজার মেদিনীপুরবাসী শামিল হয়েছিলেন ওই শোভাযাত্রায়। হাতে তাঁদের জাতীয় পতাকা। মুখে গর্জন ধ্বনি, ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো- করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে – বন্দে মাতরম্’।

পশ্চিমদিক থেকে এগিয়ে এল আট-দশ হাজার মানুষের এক বিরাট শোভাযাত্রা। গুর্খা ও ব্রিটিশ গোরা সৈন্যরা তৈরি হল অবস্থার মোকাবিলার জন্য। হাঁটু মুড়ে বসে গেল তাঁরা। তারপরই তাঁদের বন্দুকগুলো গর্জে উঠল। মারা গেলেন পাঁচজন। আহত হলেন আরও বেশ কয়েকজন।

উত্তর দিক থেকে আসছিল মাতঙ্গিনীর দলটি। তাঁরা থানার কাছাকাছি আসতেই পুলিশ ও মিলিটারি অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু করে দিল। বিদ্রোহীদের মধ্যে থেকে বেশ কয়েকজন কিছুটা পিছু হঠে গিয়েছিল। তাঁদের সতর্ক করে দিয়ে মাতঙ্গিনী বললেন, ‘থানা কোন দিকে? সামনে, না পেছনে? এগিয়ে চলো। হয় থানা দখল করো, নয়ত মরো। বলো, ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ – ‘বন্দে মাতরম’।

বিপ্লবীদের সম্বিত ফিরে এল। তাঁদের কণ্ঠেও ধ্বনিত হতে থাকল, ‘এগিয়ে চলো। ইংরেজ তুমি ভারত ছাড়ো। ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে, বন্দে মাতরম।’ আবার এগিয়ে যেতে লাগল তাঁরা উদ্দাম বেগে। ওদিকে গুলি বর্ষণ শুরু হয়ে গেল বৃষ্টির মতো।

মাতঙ্গিনী দলটির পুরোভাগে। ছুটে চলেছেন উল্কার বেগে। বাঁ-হাতে বিজয় শঙ্খ যেন পাঞ্চজন্য, ডান হাতে জাতীয় পতাকা। আর মুখে ধ্বনি- ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো-করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে – বন্দে মাতরম’।

একটি বুলেট পায়ে লাগতেই হাতের শাঁখটি মাটিতে পড়ে গেল। দ্বিতীয় বুলেটের আঘাতে বাঁ-হাতটা নুয়ে পড়ল। কিন্তু ওই অবস্থাতেও ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ভারতীয় সৈনিকদের উদ্দেশ্য করে বলে চলেছেন, ‘ব্রিটিশের গোলামি ছেড়ে গুলি ছোঁড়া বন্ধ করো – তোমরা সব আমাদের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে হাত মেলাও।’ প্রত্যুত্তরে উপহার পেয়েছিলেন কপালবিদ্ধ করা তৃতীয় বুলেটটি। প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু জাতীয় পতাকাটি তখনও তাঁর হাতের মুঠোয় ধরা। সেটি কিন্তু মাটি স্পর্শ করেনি কারণ মরতে মরতেও তিনি চিৎ হয়ে পড়লেন আর পতাকা রইল তাঁর বুকের উপর। কপালের লাগা গুলির ক্ষতস্থান দিয়ে বেরোনো রক্তে তখন সারা শরীর ভেসে গেছে। নিথর দেহে অপলক দৃষ্টিতে যেন চেয়ে আছেন ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারতের প্রত্যাশায়!

যেখানে তিনি লুটিয়ে পড়েছিলেন, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে পুরনো দিনের মানুষ আজও বীরাঙ্গনাকে স্মরণ করেন।
প্রতি বছর ১৫ আগষ্ট এলে তমলুকের বানপুকুরের পাড়ে এসে দাঁড়ান তাঁরা। স্বাধীনতা যুদ্ধের এমন তীর্থক্ষেত্রে এসে সকলেই দাঁড়ান মৃত্যঞ্জয়ী বীরাঙ্গনার জন্যই। আসলে মাতঙ্গিনী হাজরা এমনই এক চরিত্র, যিনি তাঁর সমগ্র সত্তা ও হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন উদ্দীপ্ত দেশপ্রেমের অনন্যতন্ত্রতা, অন্তঃরস্থ মনুষত্বের স্বাধীনতা।

১৯৪৭ সালে যখন ভারত স্বাধীনতা অর্জন করলো তখন অসংখ্য স্কুল, পাড়া ও রাস্তার নাম মাতঙ্গিনী হাজরার নামে উৎসর্গ করা হয়। স্বাধীন ভারতে কলকাতা শহরে প্রথম যে নারীমূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছিল, সেটি ছিল মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি। ১৯৭৭ সালে কলকাতার ময়দানে এই মূর্তিটি স্থাপিত হয়। কলকাতার ময়দান অঞ্চলে মহান বিপ্লবী মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি এখনো তার শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।