সাইকেলে চড়ে ‘চাঁদে’ পৌঁছে গিয়েছিলেন রামচন্দ্র!

News Desk:  ‘এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাব। ওই চাঁদের পাহাড় ঠিক দেখতে পাব’। সিনেমায় দুই বালক চাঁদের পাহাড়ে পৌঁছনোর স্বপ্ন দেখেছিল।বিভূতিভূষণ…

ramchandra

News Desk:  ‘এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাব। ওই চাঁদের পাহাড় ঠিক দেখতে পাব’। সিনেমায় দুই বালক চাঁদের পাহাড়ে পৌঁছনোর স্বপ্ন দেখেছিল।বিভূতিভূষণ তাঁর গল্পে শঙ্করকে চাঁদের পাহাড় পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু যদি বলি এক বাঙালি সাইকেল নিয়ে চাঁদে পৌঁছে গিয়েছিলেন। না, খুব একটা ভুল হবে না। সত্যিই তো তিনি সাইকেলে চড়ে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের সমান পথ ঘুরেছিলেন।

উত্তরপাড়ার রামচন্দ্র বিশ্বাস (Ramchandra Biswas)। ২৯ বছর ধরে সাইকেলেই ঘুরেছেন গোটা পৃথিবী। আর্জেন্টিনার বহু বাড়িতে তিনি রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখেছেন, পেরুতে দেখেছেন হিন্দি সিনেমা চলতে। ১৯৮২ সাল, ২১শে এপ্রিল। মফস্‌সল উত্তরপাড়ার দুই দামাল ছেলে, রামচন্দ্র বিশ্বাস ও সোমনাথ মুখার্জি ঠিক করলেন সাইকেলে ঘুরতে যাবেন লম্বা কোথাও।

   

সোমনাথবাবুর মতে তা ইন্ডিয়া ট্যুর হলেও রামচন্দ্র বিশ্বাস জানান তিনি ওয়ার্ল্ড ট্যুরে যেতে ইচ্ছুক। হাতে টাকা নেই, পোস্ট অফিসের সামান্য চাকরি, পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো সম্পর্কে কোনও ধারণাও নেই, নেই পাসপোর্ট, ভালো সাইকেল কিচ্ছু নেই। কেবল অদম্য ইচ্ছে রয়েছে তাঁদের। আর সেই ইচ্ছের জোরেই ভাগ্যও ছুটে আসে সঙ্গ দিতে। নির্বিঘ্নে মিটতে থাকে সমস্ত সরকারি কাজ। ততকালীন অর্থমন্ত্রীর সাহায্যে সমস্ত কাগজপত্র তৈরি হয়ে যায়, হাতে পান ৫,০০০ টাকা। এই নিয়েই ২১ এপ্রিল ১৯৮২ উত্তরপাড়া থেকে রওনা হন রামচন্দ্র, ওরফে সকলের প্রিয় ঝুনু।

ramchandra

১৯৮৬ সালে আফ্রিকায় থাকাকালীন দুই বন্ধুতে মিলে ম্যাজিক দেখিয়ে টাকা রোজকার করতেন শহরে শহরে। ঝুনু জাগলিং করতেন আর অন্যজন বাজাতেন ভায়োলিন। এরপর বিসাও নামক একটি শহরে সেট্‌ল করে যান তাঁর সঙ্গী। সালটা ১৯৮৬। যদিও ঝুনু জানতেন না তাঁর বন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন থেকে যাওয়ার। সেনেগালে পৌঁছে সঙ্গীর জন্য প্রায় একমাস অপেক্ষা করেন তিনি। সঙ্গী না আসায় তিনি বুঝতে পারেন বাকিটা পথ ওঁর একারই।

ভাষার সমস্যাও কেটে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলা রপ্ত করে ফেলেন তিনি। ভাঙা ভাঙা স্থানীয় ভাষাগুলিও শিখে নেন অল্প সময়ে। আফ্রিকার (Africa) বহু দেশে তখন গৃহযুদ্ধ চলছে। একটা করে সীমানা পেরিয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একটা করে বাধা। মানুষ তাঁকে আমেরিকার গুপ্তচর ভেবে বসছে। একমাত্র বিশ্বাস করছে বাচ্চারা। রামচন্দ্রবাবু জানান, তাঁর শেখা দশটা ভাষার দশটাই তিনি শিখেছেন বাচ্চাদের মুখ থেকে, তাদের সান্নিধ্যে।

আর্জেন্টিনার (Argentina) বহু বাড়িতে তিনি রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখেছেন, পেরুতে (Peru) দেখেছেন হিন্দি সিনেমা চলতে। ২৪ ঘণ্টা দিন পেয়েছেন যাত্রাপথে, অরোরা বোরিয়ালিসও দেখেছেন চোখের সামনে। বহু উপজাতির মানুষের দেখা পেয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে মিশেছেন এই রঙিন মানুষটি। তাঁর পাসপোর্টের দৈর্ঘ্য ১৩৯ ফুট। দু’হাতে ঝুলিয়ে সেটি এক নির্মল হাসি হেসে আমাদের জানান তিনি ফাইভস্টার হোটেলের থেকে তাঁবুতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। নিজের পাঁচ লক্ষ স্মারক কোনও সরকারি বা বেসরকারি সংগ্রহশালার দায়িত্বে দিতে চান বলেও জানিয়েছেন তিনি।

২৯ বছরের যাত্রাপথে চাঁদে গিয়ে ফিরে আসার সমান সাইকেল চালিয়েছেন ঝুনু। সারা পৃথিবীর মানুষের সান্নিধ্যে ঝুনু দেখেছেন উদারতা, অপরিচিত মানুষও তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন অসময়ে। কিন্তু ২৯ বছর পর ফিরে নিজের পরিবার নিয়ে খুব একটা খুশি হতে পারেননি তিনি। সময়টা পেরিয়ে যাওয়ায় আরও অনেক কিছুর সঙ্গেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে বেশ অসুবিধা হয়েছে তাঁর।

<

p style=”text-align: justify;”>২৯ বছরে বেশ কিছু অবক্ষয় হয়ে গেছে সমাজেরও। এই জটিলতা বারংবার কষ্ট দিয়েছে তাঁকে। ব্যানার্জি পাড়ার ওই লম্বা বাড়ির দোতলার করিডরে উঠে পড়লে মনে হবে কোনও মিউজিয়ামেই এসে গেছেন বোধহয়। অথচ আপনাকে যত্ন নিয়ে এক শিশুর মতো উৎসাহে ঝুনু তাঁর প্রতিটা জিনিস দেখাবেন ধৈর্য্য ধরে। হয়তো মফস্‌সল বলেই আজও আড়ালে বাঁচেন রামচন্দ্র বিশ্বাস। উত্তরপাড়ার এই ক্রমবর্ধমান লাখ খানেক জনসংখ্যারই বা ক’জন খোঁজ রাখেন এই রঙিন আত্মাটির!