‘Congress Radio calling…Hello everybody! অজানা জায়গা থেকে বলছি: গোপন তরঙ্গে কেঁপেছিল দেশ

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: হঠাৎ সবাই শুনেছিলেন একটা ঘড়ঘড়ে বেতার তরঙ্গ। কেটে কেটে যাচ্ছিল কথাগুলো। এ কী! এ কারা বলছে! ততক্ষণে বেতার বার্তায় ভেসে এসেছে মহিলা কণ্ঠ…

Radio

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: হঠাৎ সবাই শুনেছিলেন একটা ঘড়ঘড়ে বেতার তরঙ্গ। কেটে কেটে যাচ্ছিল কথাগুলো। এ কী! এ কারা বলছে! ততক্ষণে বেতার বার্তায় ভেসে এসেছে মহিলা কণ্ঠ ” This is Congress Radio calling on ( a wavelength of ) 42.34 meters from somewhere in India….” ।

১৯৪২ এর মহাকাল ঘূর্ণি তখন ভারতের বুকে রাজনৈতিক ঘনঘটা তৈরি করেছে। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ চলছিল। আর ভারত জুডে চলছিল ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলন-ভারত ছাড়ো আন্দোলন। মহাত্মা গান্ধী ডাক দিয়েছেন। তেড়েফুঁড়ে নেমেছিল কংগ্রেস। সে এক আগ্রাসী আন্দোলন। যা কিনা এখন জাতীয় কংগ্রেসের চরিত্রের সঙ্গে মেলেনা।

   

Redio

সেরকমই সময়ে অর্থাৎ ১৯৪২ সালের ২৭ জুলাই, বম্বেবাসীদের কানে এসে ধাক্কা মেরেছিল কংগ্রেস বেতার। সবাই চমকে গেলেন। গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত এই তরঙ্গবার্তার নাম ‘কংগ্রেস রেডিও’।

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধীর ডাকে গণ আন্দোলন শুরু হয়। বৃটিশ সরকার গান্ধী সহ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার করে। দেশজুড়ে সেই আন্দোলন ভয়ংকর চেহারা নেয়। পুলিশের গুলিতে কয়েক হাজার আন্দোলনকারী প্রাণ হারান। ভারত রক্ষা আইনে আটক হন বহু আন্দোলনকারী। জেলবন্দি কংগ্রেস নেতারা। জনগণ দিশাহীন ততটাই আগ্রাসী। চলছে ভাঙচুর, রেললাইন উপড়ে দেওয়া, থানায় হামলা। ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচার চলছে একই গতিতে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের খবর সবসময় পৌঁছে দিতে মরিয়া জাতীয় কংগ্রেসের সমাজতান্ত্রিক নেতা রামমনোহর লোহিয়া। এগিয়ে এলেন কংগ্রেস নেত্রী ঊষা মেহতা। নেতা ও সাধারণ কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য এক গোপন বেতারের শুরু হলো তাঁর কণ্ঠ দিয়ে।

এ যেন গুপ্তচরের কাজ! গোপনে বার্তা পাঠানো। উষা মেহতা কয়েকজন কংগ্রেস কর্মীর সহযোগিতায়  রামমনোহর লোহিয়া, ভিট্টলদাস খক্কর, বাবু ভাই টক্কর, চন্দ্রকান্ত জাভেরি প্রমুখ বিশিষ্ট নেতাদের উদ্যোগে তৈরি করছেন সিক্রেট কংগ্রেস রেডিও সার্ভিস।

ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরুর ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যেই বম্বের এক গোপন আস্তানা হতে ১৪ই আগস্ট বেতার সম্প্রচারে ভেসে এলো মহিলার কণ্ঠস্বর- ” This is Congress Radio calling on ( a wavelength of ) 42.34 meters from somewhere in India….” [আমি ভারতের কোন এক জায়গা থেকে ৪২.৩৪ মিটার বেতার তরঙ্গে চালিত কংগ্রেস রেডিও থেকে বলছি…]

সে এক হই হই কাণ্ড। ব্রিটিশরাজ চমকে গেল। তৈরি হল কাউন্টার এসপিয়াওনেজ টিম বা প্রতিগুপ্তচর বাহিনি। তারা খুঁজছে সিক্রেট কংগ্রেস রেডিও অপারেটরদের। দুই পক্ষের লুকোচুরি চলছে। কংগ্রেস রেডিও কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, মাঠে ময়দানে, ভাঙা বাড়ির কোনা, নর্দমার ভিতর ডুবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিভিন্ন খবর ‘হার্ড নিউজ’ ও কথিকা, নেতাদের নির্দেশ পাঠাতে শুরু করলেন। ব্রিটিশ পুলিশের কাছে যেসব নিষিদ্ধ, সেই খবর জনতার কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছিল। বম্বে থেকে অন্যান্য প্রদেশের নেতাদের সাথে যোগাযোগ রেখে নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজ চলত সন্তর্পণে।

কেমন ছিল এই কংগ্রেস রেডিও অপারেটরদের কাজ

পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য প্রায়ই প্রচার কেন্দ্র বদল হতো। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকের অভাব নেই। তার দেওয়া খবরে, কংগ্রেস বেতার কেন্দ্রের প্রধান ঊষা মেহতা সহ সকলেই গ্রেফতার হন। ছয় মাস ধরে জেরা চলেছিল। নির্বাক ছিলেন উষা মেহতা। জেলে ছিলেন চার বছর।

বম্বে থেকে কলকাতা: কংগ্রেস বেতার সম্প্রচার শুরু

কংগ্রেস সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা লোহিয়া থামতে জানেননা। তাঁর উদ্যোগে গোপন বেতারকেন্দ্র খোলা হয়েছিল কলকাতায়। চারজন পরিচালক উদয়ন চট্টোপাধ্যায়, সম্বরণ চট্টোপাধ্যায়, মোহন সিং স্যাণ্ডার ও দিলীপকুমার বিশ্বাস।

নিষিদ্ধ কংগ্রেস রেডিও শর্ট ওয়েভে বাংলায় পরিচালনা করতেন দিলীপকুমার বিশ্বাস৷ হিন্দিতে বলতেন মোহন সিং স্যাণ্ডার৷ এটা ছিল রামমোহন লোহিয়ার পরিকল্পনা৷ রাত নটা থেকে শুরু হতো বার্তা দেওয়া।

শুরুতেই থাকত “This is a Congress Radio Calling from somewhere in India. Hallo everybody! Here is the news” – এই কথাগুলিই বলেই খবর পড়তেন উদয়ন চট্টোপাধ্যায়। এমনও নজির আছে, আবহাওয়া ভালো থাকলে সুদূর বার্মাতে (মায়ানমার) এই সম্প্রচার শোনা যেত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ব্ল্যাক আউটের রাত। কংগ্রেস ও সোশ্যালিস্ট কর্মীরা চলেছেন মাঠের পাশ দিয়ে। কলকাতার বাইরে কোনো এক স্থান। সুবিধা মতো এলাকা বেছে অপারেটর অন করলেন বেতার বাক্সের সুইচ। তার পরেই সেই বিখ্যাত কয়েকটি বাক্য দিয়ে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের আগামী কর্মসূচী ও হামলার খবর ছড়িয়ে দিলেন তাঁরা।

১৯৪৩ সালের কথা। আন্দোলন চলছে। কলকাতার আকাশে জাপানি অক্ষশক্তি বিমানের গর্জন। বরানগরে বোমা নিক্ষেপ করল জাপান। ঘটনার সময় কংগ্রেস বেতারতর্মীরা রোজকার সংবাদ দিচ্ছিলেন। একটানা তিন ঘণ্টা হোসপাইপের মধ্যে শুয়ে কাটান তাঁরা। রোমহর্ষক কাণ্ড। এই ছিল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। যারা নরম ও চরমপন্থী শিবিরে বিভক্ত। নাহ, ব্রিটিশ পুলিশ পায়নি সেই বেতারযন্ত্রগুলি। তবে কয়েকজন ধরা পড়েন। তখন ভারত স্বাধীনতার একেবারে মুখে দাঁড়িয়ে আছে।